ছয় মাস বয়সী শিশুর ক্রিয়াকলাপ, বিকাশ এবং পরিচর্যা পদ্ধতি | Sixth Month Baby Development In Bengali
In This Article
সন্তান জন্মের পর মুহূর্ত থেকেই প্রত্যেক মা-বাবার জীবনেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। জীবনের অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত হয় সন্তান প্রতিপালনের গুরু দায়িত্ব। শিশুর জন্মের পর থেকেই সময়ের সাথে সাথে তার শারীরিক, মানসিক বিকাশ পরিলক্ষিত হয় ও আসতে আসতে শিশু বড়ো হতে থাকে । আর এই বিকাশের সময় স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর মা-বাবা তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই সময় প্রত্যেক শিশুর ক্ষেত্রেই অত্যন্ত যত্ন সহকারে পরিচর্যার প্রয়োজন হয়, যার ফলাফল তার জীবনের পরবর্তী সময়েও সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধে আমরা ছয় মাস বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ এবং তাদের পরিচর্যার পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হয়।
ছয় মাস বয়সী শিশুর বিকাশের মাপকাঠি কী হওয়া উচিৎ ?
এই বয়সে একজন শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগ সংক্রান্ত বিষয়গুলি অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলোচ্য প্রবন্ধে এই সবকটি বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মানসিক বিকাশ
১। মুখের দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকানো – এই বয়সী শিশুরা তার আসেপাশে থাকা মানুষের মুখের দিকে বিশেষ নজর দেয়। এবং সামাণ্য পরিচিত কোনো চেহারা আসেপাশে না দেখতে পেলে সেটা খোঁজার চেষ্টা করে।
২। কন্ঠস্বর বা গলার আওয়াজ শোনা – একটি শিশু যখন তার আসপাশ থেকে কোনো কন্ঠস্বর শোনে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার মনোযোগ ঐ শব্দের উৎসের প্রতি চলে যায়। কোথা থেকে ঐ শব্দ আসছে শিশু সেটা খোঁজার চেষ্টা করে।
৩। ভিন্ন গলার স্বর এবং ভঙ্গিমায় কান্না – এই সময় যে কোনো শিশুরই ভাব প্রকাশের ভাষা মূলত হাসি এবং কান্না হয়। কোনোরকম শারীরিক অস্বস্তি, খিদে-তেষ্টা বা যাবতীয় অপছন্দের প্রকাশ শিশু ভিন্ন স্বরে কান্নার মাধ্যমে করে থাকে। নিজের অনুভূতি গুলির সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্যই শিশুরা এমনটা করে থাকে বলে মনে করা হয়।
শারীরিক বিকাশ
১। পেশীর গঠন শক্তিশালী – শিশুর ঘাড়ের পেশি কিছুটা হলেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে এতোটাও শক্তিশালী নয় যে শিশুকে কোলে বা বিছানায় বসিয়ে রাখলে সে ঘাড় – মাথা সোজা করে বসতে পারবে।
২। মাথা উঁচু করতে পারে – এই সময় শিশুর অন্যান্য সব শারীরিক বিকাশের মধ্যে অন্যতম একটি হলো মাথা উঁচু করতে পারা। একটি শিশুকে শুইয়ে রাখলে তখন সে মাথা উঁচু করার চেষ্টা করে। প্রায় ৪৫ ডিগ্রী পর্যন্ত মাথা উঁচু করতে পারে এই সময় শিশুরা।
৩। শরীর ওপরে তোলার চেষ্টা – শিশুর কাঁধের পেশি বেশ কিছুটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সময় শিশুদের শুইয়ে রাখলে সে তার দুই হাতের সাহায্যে শরীর ওপরে তলার চেষ্টা করে।
৪। গতিশীল জিনিস এবং মানুষ দেখে – যদি কেউ শিশুর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় অথবা কোনো কিছু কেঁপে ওঠে তাহলে সে ঐ জিনিস দেখতে পায়। উদাহরণ দিয়ে বললে, যদি কোনো ব্যক্তি, শিশুর সামনে দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায় তাহলে শিশু ঐ ব্যক্তির চলে যাওয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পারে এবং যতদূর পর্যন্ত দেখা সম্ভব সে দেখতে থাকে। (1)
৫। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রন – শিশুর নিজের হাত এবং পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রন চলে আসে। যখন কোনো শিশু হাওয়ার অভিমুখে জোরে হাত পা নাড়তে পারে সেটা দেখেই শিশুর হাত পায়ের প্রতি নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে জানা যায়।
৬। উন্নত দৃষ্টি শক্তি – এই সময় থেকে শিশুর দৃষ্টি শক্তি উন্নত হতে শুরু করে। জিনিস পত্রের ওপর পূর্ববর্তী সময়ের থেকে ভালোভাবে নজর দিতে শিশু এই সময়। সেভাবে দেখলে একজন ছয় মাস বয়সী শিশু একটা গতিশীল বস্তুর ওপর নজর রাখতে পারে।
সামাজিক এবং আবেগ অনুভূতির বিকাশ –
- হাসি – প্রত্যেক মা বাবা তার সন্তানের হাসি মুখ দেখতে চায়। শিশুর ছয় মাস বয়স থেকেই তার মুখে হাসি দেখতে পাওয়া যায়। আর ছয় মাস বয়সে শিশু খিলখিলিয়ে হাসতে শিখে যায়।
- কিছু সময়ের জন্য শান্ত – এই বয়সী শিশুরা কাঁদার সময় মুখের মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে ফেলে। এতে করে কিছু সময়ের জন্য হলেও সে চুপ করে যায়। এরফলে ঐ শিশুর জন্য একটা আরামদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ছয় মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে কোন কোন টীকাকরণ করা জরুরী?
একটি ছয় মাস বয়সী শিশু শারীরিক ভাবে খুবই দুর্বল প্রকৃতির হয়। সহজেই রোগ জীবানুর সংক্রমনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে এই সময় শিশুদের। তবে রোগ জীবানু সংক্রমন থেকে শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য শিশুদের জন্য বিভিন্ন টীকাকরণের প্রয়োজন। কোন সময়ে কোন টীকা করণ জরুরী তা জানার জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠ থেকে নবম সপ্তাহের মধ্যে যে যে টীকা গুলি একজন শিশুর গ্রহণ করা জরুরী সেগুলি হলো যথাক্রমে – (2)
- ডি ট্যাপ টীকা ( ডিফথেরিয়া, টিটেনাস, এসিটুলার পারটাসি প্রভৃতি সংক্রমন প্রতিরোধক টীকা)
- এইচআইবি টীকা ( হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি)
- আইপিবি ১ (পোলিও টীকা)
- আরবি (রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন মাসিক টীকা)
- এইচভিবি (হেপাটাইটিস বি টীকা, যদি আগে দেওয়া না হয়ে থাকে।)
ছয় মাসের শিশুদের জন্য কতটা দুধ পান করা জরুরী ?
জন্মের পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত শিশুদের পাচনতন্ত্র দুর্বল প্রকৃতির হয়। সেইজন্য এই সময় শিশুদের প্রধাণত মায়ের দুধ খাওয়ানোই দরকার। তবে পরিস্থিতি ভেদে শিশুদের ফর্মূলা ১ দুধ পান করানো জরুরী হয়ে পরে। ছয় মাস বয়েসে অনেক বাচ্চাই স্তন্যপান কমিয়ে দিতে শুরু করে।
ছয় মাস বয়সের শিশুদের মা-বাবার সাধারণ স্বাস্থ্য চিন্তা
যে কোনো কারণে আপনার শিশু হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই আপনার কাছে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরী হয়ে যায়। অসুস্থ্য শিশুদের সামলানোও বেশ কঠিন হয়ে যায়। শিশুরা যাতে সহজে অসুস্থ্য হয়ে না পড়ে সেইজন্য মা-বাবা কে খুবই সচেতনভাবে সন্তানের যত্ন নিতে হয়। এখানে শিশুদের সাধারণ কয়েকটা শারীরিক সমস্যা এবং সেই সমস্যার উপশমকারী চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
১। ত্বকের সমস্যা – শিশুদের ত্বক খুবই নরম হয়। এই সময়ে তাদের ত্বকের বিশের যত্ন গ্রহণ করা জরুরী। তা নাহলে ত্বকে নানারকম সমস্যা দেখা যেতে পারে। এখানে বেশ কয়েকটি ত্বকের সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হবে।
- ডায়পার র্যাশ বা ফুসকুরি – দীর্ঘ সময় ধরে ভেজা অপরিষ্কার ডায়পার অথবা ন্যাকড়া পরে থাকার ফলে শিশুদের এই ধরণের ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। এই ধরণের ফুসকুরি শিশুদের যৌনাঙ্গ এবং এবং নিতম্বের চারিদিকে দেখা যায়। সাধারণত লাল বর্ণের হয় ফুসকুড়িগুলি।
- চিকিৎসা পদ্ধতি – একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর শিশুদের ডায়পার বদল করতে থাকুন। ডায়পার বদলের সময় শিশুদের ত্বক পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং ত্বকে বেবি পাওডার বা ময়েশ্চারাইজার লাগানো দরকার। তবে দিনের কিছুটা সময় শিশুদের ডায়পার ছাড়া রাখা দরকার তাতে ত্বক বাতাসের আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসতে পারে।
- হিট র্যাশ বা উত্তাপের ফলে ঘামাচি – রোম কূপ বন্ধ হয়ে গেলে ঘাম ত্বকের নীচে আটকে থাকে। যা ত্বকে ঘামাচি জন্ম দেয়। সাধারণত গ্রীষ্মকালেই এমনটা হয়। শিশুর শরীরে ছোটো ছোটো, লাল রঙের, তরল পূর্ণ ফোস্কা আকারে এই ঘামাচি বা র্যাশ দেখা যায়।
- চিকিৎসা পদ্ধতি – গ্রীষ্মকালে শিশুদের শরীর থেকে অতিরিক্ত পোষাক খুলে ফেলুন। শিশুদের জন্য হালকা, নরম, ঢিলে ঢালা আরামদায়ক পোষাক ব্যবহার করুন। ত্বকের এইসব সমস্যা থেকে শিশুদের সাবধানে রাখার জন্য গ্রীষ্মকালে তাদের ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক পরিবেশে রাখা দরকার। এছাড়াও গরমের সময় ত্বকের সমস্যা থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হলে বেবি পাওডার ব্যবহার করুন।
- এগজিমা- এটি এক ধরণের ত্বকের সংক্রমন। সাধারণত শুষ্ক, ঘন, মরমরে ছাল যুক্ত ছোট লাল গোলাকারে আবির্ভূত হয়। এই ধরণের ত্বকের সমস্যা শিশুদের কপাল, গাল, বা মাথার ত্বকে দেখতে পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নাহলে ত্বকের এই সংক্রমন শিশুদের হাত, পা, বুক এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পরে।
- চিকিৎসা পদ্ধতি – এই ধরণের ত্বকের সমস্যায় অবিলম্বে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে শিশুর ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন। আর ত্বকের সময়ার ক্ষেত্রে শিশুদের পাতলা, নরম, এবং ঢিলেঢালা জামা পড়ানো দরকার।
২। কাশির সমস্যা – কাশির ফলে গলা এবং শ্বাসনালী পথ পরিষ্কার থাকে একথা ঠিকই। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি যদি সহজেই না কমে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী।
শিশুদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিশেষ নজর দেওয়া দরকার
প্রত্যেক মা – বাবা চায় তাদের সন্তান সুস্থ্য সবল হোক। শিশুদের সুস্বাস্থ্য গঠনের জন্য তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
১। শিশুর মুখ এবং মাথা পরিষ্কার করা – আপনার সন্তানকে প্রতিদিন স্নানের পরিবর্তে একদিন অন্তর স্নান করাতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে প্রতিদিন শিশুর মাথা, মুখ এবং শরীর ঈষদোষ্ণ গরম জলে ভেজা নরম পাতলা কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করতে হবে। সাবানের ব্যবহার করা এই সময় খুব একটা জরুরী নয়।
২। নখ – প্রতিদিন শিশুর নখ পরিষ্কার করা উচিৎ এবং একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিশুদের নখ কাটা দরকার। অনেক সময়ই নখের মধ্যে ময়লা ঢুকে থাকে এবং সেই ময়লা যুক্ত নখওলা আঙুল শিশু মুখে দিলে শরীরের মধ্যে ময়লা প্রবেশ করার একটা সম্ভবনা তৈরী হয়। এছাড়াও নখের দৈর্ঘ্য বড় হয়ে গেলে তা দিয়ে শিশু নিজের অজান্তেই শরীরের ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের নখ কাটার জন্য নির্মিত যন্ত্রের সাহায্যেই শিশুদের নখ কাটা উচিৎ। (3)
৩। গর্ভনালিকা – এই নালিকা পরিষ্কার করার জন্য গরম হলে তুলো ভিজিয়ে এবং সেই তুলো থেকে অতিরিক্ত জল বের করে নিতে হবে। এরপরে ধীরে ধীরে প্লাসেন্টা এবং তার পার্শ্ববর্তী ত্বক পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হলে পরিষ্কার এবং শুকনো কাপড় দিয়ে সংশ্লিষ্ট স্থান মুছে নিতে হবে। মনে রাখবেন গর্ভ নালিকা যতক্ষণ স্বাভাবিক ভাবে অপসারিত হচ্ছে নিয়মিত এই নালিকা পরিষ্কার এবং শুষ্ক রাখা দরকার।
৪। যৌনাঙ্গের যত্ন – আপনার সন্তানের ন্যাপির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। নির্দিষ্ট সময় অতর ন্যাপি বদল করা জরুরী। তা নাহলে ভিজে ন্যাপি ত্বকের সংস্পর্শে বেশি সময় থাকলে ত্বকে সংক্রমন হওয়ার সম্ভবনা দেখা যায়। এছাড়াও শিশুর যৌনাঙ্গের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার।
প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্নাবলী
1. আমার ছয় মাস বয়সী সন্তানের জন্য সারারাত ধরে ঘুমোনো কী ঠিক?
উঃ– হ্যাঁ ঘুমাতেই পারে।
2. ছয় মাস বয়সী শিশু কী রঙ দেখতে পায়?
উঃ– হ্যাঁ, এই বয়সের শিশুরা রঙ দেখতে পায় এবং এই সময় থেকে দৃষ্টিশক্তি প্রখর হতে থাকে।
References
2. Vaccination rate of premature infants at 6 and 24 months of age: a pilot study by NCBI
3. Skin Physiology of the Neonate and Infant: Clinical Implications by NCBI
Community Experiences
Join the conversation and become a part of our vibrant community! Share your stories, experiences, and insights to connect with like-minded individuals.