এগারো মাস বয়সী শিশুর যত্ন এবং বিকাশ |  11 month-Old’s Developmental Milestones In Bengali

Written by
Last Updated on

In This Article

জন্মের পর থেকেই শিশু যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে প্রত্যেক মাসেই তার এক একটি অঙ্গের বিকাশ ঘটে। এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর বিকাশ অনেকটা হয়ে যায়। কেননা সে একটি গোটা বছর পূর্ণ করার দিকে পা রাখে। এই সময় শিশুটি প্রত্যেকদিন নতুন আদব-কায়দা দেখিয়ে আপনাকে অবাক করে তুলবে। আপনার ছোট্ট সোনামণি টি কখন এত কিছু শিখে গেছে ভাবতে ভাবতেই তার এক বছর বয়স পূর্ণ হবে। এগারো মাস বয়সে এসে শিশু নিজের মতো করে ধ্যান ধারণা তৈরি হয়, তার হ্যাঁ এবং না সম্মতি হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কিছু সাহায্য নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে পারে। হাত দিয়ে খেতে পারে, নিজের পছন্দের খেলনা দিয়ে খেলতে পারে, নিজের কাছের মানুষদের চিনতে পারে। এই ভাবেই শিশুটির এগারো মাস বয়স অতিক্রান্ত হয়। জন্মের পর থেকে এগারো মাস বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজে নিজে কিংবা আশেপাশের মানুষের সহায়তায় একটি ছোট শিশু অনেক কিছু অর্জন করে থাকে। আজকে আমরা এই নিবন্ধ থেকে জানবো এগারো মাস বয়সের শিশুর কি কি চাহিদা তৈরি হয়, মানসিকতার কীরূপ পরিবর্তন ঘটে, শিশুর কি কি যত্নআত্তিরের প্রয়োজন, তার কি কি খাওয়া উচিত, একটি শিশু কি কি করতে পারে, বাবা-মায়েদের শিশুর কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করা উচিত, কোন বিষয়ে সাহায্য করা উচিত, সবরকম বিষয় নিয়ে আজকের নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব।

এগারো মাস বয়সী শিশুর ওজন এবং উচ্চতা কত হওয়া উচিত?

এগারো মাস বয়সে এসে শিশুদের উচ্চতা এবং ওজন আগের তুলনায় কিছুটা বিকশিত হয়। এই সময় থেকে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে থাকে। তবে এই বয়সে শিশুর ওজন বৃদ্ধির তুলনায় উচ্চতা বেশি বাড়ে। যার ফলে এগারো মাস বয়স থেকে শিশু কোনও কিছু সহায়তায় নিজে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, হাঁটার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে যদি শিশুর বাড়ির লোক তাকে সহায়তা করে তাহলে কোন কোন শিশু কোনও কিছুর সহায়তা ছাড়াই হাঁটতে পারে। (1)

এগারো মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে মেয়েদের গড় ওজন হয় ১৯.২ পাউন্ড এবং ছেলেদের গড় ওজন হয় ২০.৮ পাউন্ড। মেয়েদের গড় উচ্চতা হয় ২৮.৭ ইঞ্চি এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে গড় উচ্চতা হয় ২৯.৩ ইঞ্চি। বাচ্চারা প্রতি মাসেই আধা ইঞ্চি করে লম্বা হয় এবং প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ আউন্স করে ওজন বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে জন্মের পর থেকে প্রতিমাসে যদি শিশুর ছবি তুলে রাখেন শিশুর বিকাশ ভালোমতো বুঝতে পারবেন। যদি কোনো মাসে শিশুর যথাযথ বিকাশ না হয় কিংবা ওজন না বাড়ে তার আগের মাসের ছবি দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন এবং অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করবেন। কেননা শিশু যদি সুস্থ থাকে প্রত্যেক মাসেই তার ওজন এবং উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। তাই এর ব্যতিক্রম হলে শিশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। অবশ্যক চিকিৎসককে শিশুর নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি বলতে ভুলবেন না।

এগারো মাস বয়সী শিশুর বিকাশের মাইলফলক গুলি কি?

এগারো মাস বয়সে এসে আপনার শিশুর অনেকটাই বিকাশ হয়ে যায়। সে এক বছর পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে যায়। এই সময় সে আগের থেকে অনেকটাই পরিণত হয়ে যায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, চারদিকে ঘুরতে পারে, নিজে হাত দিয়ে খেতে পারে,  পছন্দের খেলনা নিয়ে খেলতে পারে,  এই সময় তার বৃদ্ধি অনেকটাই এগিয়ে যায়।  এগারো মাস বয়সে এসে শিশু  কিছুর সমর্থন ছাড়াই দাঁড়াতে পারে,  কারো সহায়তায় হাঁটতে পারে,  সমর্থন ছাড়াই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। প্রাথমিক নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে পারে,  জটিল নির্দেশাবলী কিংবা আদেশ বুঝতে পারে,  নিজের আঙ্গুলের সাহায্যে তার খেলনা গুলি ধরতে পারে এবং নড়াচড়া করতে পারে।  আঙ্গুল দিয়ে দূরের জিনিস দেখাতে পারে, কাউকে ডাকতে পারে।  নিজের পিতা মাতা কে সম্পূর্ণরূপে চিনতে পারে।  নিজের আশেপাশের আত্মীয়ের নাম মনে রাখতে পারে।  নিজের সম্পর্ক গুলো সম্পর্কে জানতে পারে, নিজের খেলনা গুলির নাম জানে,  ঘরের অন্যান্য জিনিসের নাম মনে করতে পারে,  সহজ এবং ছোট ছোট শব্দগুলি বলতে পারে,  পিতামাতার কাছ থেকে জটিল শব্দ শুনে বলার চেষ্টা করে,  আগের তুলনায় অনেক বেশি ধরনের খাবার খেতে পারে,  শক্ত খাবারে তারা আনন্দ পায় এবং খাবারের স্বাদ ভালোমতো বুঝতে পারে।  অপরিচিত ব্যক্তির কাছে সেখান থেকে নিজের চেনা মুখটি খুঁজে নিতে পারে,  হাসিমুখে নিজের লোকের কাছে যেতে পারে,  নিজের অস্বস্তিটা তার আচরণের মাধ্যমে বোঝাতে পারে,  তার হতাশা দুঃখটা বোঝাতে সক্ষম হয়।  তার ব্যবহার্য জিনিস গুলো ব্যবহারের কথা মনে থাকে,  এছাড়াও বেশ কিছু নতুন নতুন জিনিসের ব্যবহার শিখতে পারে। শিশুর জীবনের বিকাশের মাইলফলকের বিভাগগুলোতে আমরা শিশুর জ্ঞানীয়তা,  যৌক্তিকতা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার শারীরিক বৃদ্ধি, পেশীবহুল ক্ষমতা, নিজস্ব দক্ষতা এবং তার আবেগময় স্বভাব,  মানুষের জীবনের সাথে তার সামাজিক বন্ধন,  বিকাশের দক্ষতা এই সমস্ত সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। আসুন জেনে নিন তাহলে শিশুর বিকাশমূলক মাইলফলক গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

এগারো মাস বয়সের শিশুর বিকাশের মাইলফলক গুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।

যথা : জ্ঞানভিত্তিক মাইলফলক,

শারীরিক মাইলফলক,

সামাজিক এবং সংবেদনশীল মাইলফলক।

এবার জেনে নিন প্রত্যেকটা বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে।

জ্ঞানীয় বিকাশের মাইলফলক

এই বিভাগে আমরা শিশুর জ্ঞানীয়তা, যৌক্তিকতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কিত মাইলফলক গুলি সম্পর্কে আলোচনা করব। (2)

  1. লোককে তাদের নাম দিয়ে চেনে : এগারো মাস বয়সে একটি শিশু তার দিদি দাদা বাবা মা কিংবা তাঁর বাড়িতে থাকা ছোট মানুষটিকে সরাসরি তার নাম দিয়ে চিনতে পারে। এক্ষেত্রে কারো নাম ধরে শিশুটির সামনে জিজ্ঞেস করলে সে আঙ্গুল দিয়ে সরাসরি পরিবারের সেই সদস্যের দিকে দেখিয়ে দেয়।  তার খেলনা এবং ঘরের জিনিসপত্র গুলি সম্পর্কেও যদি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করা হয় নাম ধরে এক্ষেত্রেও শিশুটি আঙ্গুল দিয়ে জিনিস টা দেখিয়ে দেয়।
  1. খেলনা দিয়ে নতুন খেলার উপায় বের করে : এই বয়সে এসে শিশু তার পুরনো খেলনা গুলি দিয়েই নতুন নতুন খেলার পদ্ধতি বার করে। এই সময়ে শিশুটি তার কোন খেলনা কে ভেঙে আবার সেটাকে নতুন করে তৈরি করতে পারে। সাধারণত এই সময় থেকেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হতে থাকে, যার ফলে শিশু নতুন কিছু পরীক্ষা করে দেখতে চায়। অনেক সময় পাজেল গেম যদি শিশুদের দেওয়া হয় কিংবা রঙিন বল শিশুদের সাজাতে দেওয়া হয় তারা সে গুলি পরপর সুন্দরভাবে অন্য জিনিস দেখে সাজাতে পারে। এর ফলে শিশুদের উন্নত সংবেদন এবং দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
  1. নির্দিষ্ট জিনিসগুলির ব্যবহার জানে : এই বয়স থেকেই শিশু তার হাতের কাছের জিনিস গুলির ব্যবহার জেনে যায়। কিভাবে কাপ দিয়ে দুধ খাবে, জলের বোতল দিয়ে জল খাবে, কিভাবে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াবে এই বিষয়গুলি শিশু করতে পারে। এগারো মাস বয়সী একটি শিশুকে যদি প্রত্যক্ষ করে দেখেন তাহলে লক্ষ্য করবেন শিশুটি তার আশেপাশের মানুষজন কি করছে, কোন জিনিস কি কাজে ব্যবহার করছে সেটি ভালো করে লক্ষ্য রাখছে এবং সেগুলি পরবর্তী সময়ে নিজে করার চেষ্টা করে।
  1. ‘না’ বোঝে : হয়তো শিশুটি খুব দুষ্টুমি করছে এবং আপনি তাকে কঠোরভাবে সেটি করার জন্য না বলুন, দেখবেন শিশুটি আপনার দিকে তখনি তাকাবে এবং যেটি করছে তা থেমে যাবে। যেমন ধরুন হয়তো শিশুটি খাচ্ছে না, এদিক ওদিক মাথা ঘুরাচ্ছে তখন আস্তে করে তাকে না বলুন, দেখবেন আপনার এগারো মাস বয়সি শিশুটি এই না এর কারণ বুঝতে পারবে এবং সে মাথা ঘোরানো বন্ধ করে দেবে। এছাড়াও শিশুটি যদি কোন বিষয়ে বিরক্ত হয় সেই বিষয়টি বোঝানোর জন্য অনেক সময় শিশুরা না শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। (3)
  1. সহজ নির্দেশাবলী মেনে চলে : এই বয়সে শিশু যদি না শব্দটির অর্থ বুঝতে পারেন তাহলে শিশুটি অন্যান্য কয়েকটি শব্দের অর্থ বুঝতে পারবে। যেমন এগারো মাস বয়সের শিশুদের যখন বলা হয় কোনও জিনিস বেছে নিতে কিংবা হাতে ধরে দিতে কিংবা কখনও বলা হয় বল ছুঁড়ে দিতে কিংবা কাউকে দিয়ে দিতে, এই নির্দেশনাবলী শিশু বুঝতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সবকথা মুখে না বলে শিশুর সামনে গিয়ে তার হাতে রেখে যদি বুঝিয়ে বলেন তাহলে শিশুটি দ্রুত তা বুঝতে পারবে।
  1. সাধারণ শব্দগুলির পুনরাবৃত্তি করবে : এগারো মাস বয়সে শিশুরা একই কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে আপনি চেষ্টা করবেন শিশু যাতে একটি কথা একবারে বলার চেষ্টা করে। আপনি তার সাথে কথা বলবেন। এক্ষেত্রে শিশুর ভাষা হয়তো সরাসরি আপনি নাও বুঝতে পারেন, তবে লক্ষ্য রাখবেন এই সময় শিশুর কণ্ঠস্বর আগের তুলনায় অনেক বিকশিত হয় এবং শিশুটিকে আপনি যা বলছেন সেটি পুনরাবৃত্তি না করে বলবেন যাতে শিশুটি একবারে কথাটি বলার চেষ্টা করে। (4)
  1. ভাষার পরীক্ষা করবে : এগারো মাস বয়সী শিশুরা ভাষার পুনরাবৃত্তি করার পাশাপাশি শব্দ নিয়ে পরীক্ষা করে তারা মুখে বিভিন্ন শব্দ করে মৌলিক স্বর তৈরি করে এবং ব্যাঞ্জনাত্বক শব্দগুলি সূক্ষ্মভাবে গানের মতো করে শোনায়। এগুলি আসলে শিশুর ভাষার বিকাশ এর লক্ষণ। এই সময়ে আপনার শিশুকে এমন কিছু বাক্য শিখিয়ে দেবেন যা আপনার কথা শুনে শুনে শিশুকে মনে রাখতে সহায়তা করবে।

শারীরিক বিকাশ মূলক মাইলফলক

এখানে আমরা এগারো মাস বয়সী শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, পেশীবহুল ক্ষমতা এবং তার কার্যকারিতা সম্পর্কিত মাইলফলক গুলি সম্পর্কে আলোচনা করব।

  1. কোনও বস্তুর কাছে পৌছানোর সময় অবস্থান পরিবর্তন করে : শিশু বসে থাকা অবস্থায় যদি তাকে কোন বস্তুর কাছে পৌঁছাতে হয় তখন সে তার প্রয়োজনীয় জিনিসটি ধরার জন্য যদি বেঁকে যেতে লাগে তবে শিশুটি ঠিক তাই করবে। এগারো মাস বয়সী শিশু তার নাগালের বাইরে থাকা জিনিসগুলি ধরার জন্য তার শরীরের সমস্ত পেশিগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করবে।
  1. নিজে দাঁড়াতে পারে : এগারো মাস বয়সে এসে শিশু কোন কিছুর সমর্থন ছাড়াই দাঁড়াতে পারে। শুরুর দিকে ভয় পেয়ে সামান্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে, তবে বাবা-মায়েরা যদি সামান্য সহযোগিতা করেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে শিশুরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে গেছে।
  1. সমর্থন ছাড়াই পদক্ষেপ ফেলতে পারে : এই সময় আপনার শিশু প্রথমে কিছু সাহায্য নিয়ে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলে পায়ে পরীক্ষা করে নেবে। এরপরে তার পেশি গুলিতে যখন শক্তি পেয়ে যাবে সে নিজে নিজেই পরবর্তী পদক্ষেপ গুলি ফেলতে সমর্থ হবে। এমনকি সে আনন্দিত হয়ে একা একাই হাঁটতে শুরু করবে। এটি শিশুটির বিকাশের পরবর্তী মাইলফলকে তাকে পৌঁছে দেয়।
  1. সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে : এগারো মাস বয়স থেকেই শিশু হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা রেলিং ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে এবং প্রথম প্রচেষ্টাকে সফল না হলেও দ্বিতীয় চেষ্টাতে সফল হয়ে যায়। যদিও সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলার পরে শিশুর শরীরে এক ধরনের ঝাঁকুনি হয়। তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে এই সময় শিশুর বাড়ির লোকজনকে সতর্ক থাকতে হবে, কেননা শিশুটি সিঁড়িতে উঠতে গেলে হঠাৎ করে পিছন ফিরলে তার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বাড়িতে  যদি সিঁড়ি থাকে এই সময় সেটি আটকে রাখুন কিংবা শিশুকে চোখে চোখে রাখুন।
  1. শিশুর আঙ্গুলের ব্যবহার করতে পারে : এই সময় শিশুর আঙ্গুল আগের থেকে আরও বেশি বিকশিত হয় এবং সে একটি চামচ ধরে নিজে খেতে পারে। লক্ষ করে দেখবেন তার বুড়ো আঙ্গুলের মধ্যে আগের তুলনায় ধরার শক্তি অনেকটা উন্নত হয়। একটি এগারো মাস বয়সী শিশু তার চারপাশের জিনিসগুলো পছন্দসই জায়গায় রাখতে কিংবা হাত দিয়ে কাউকে ডাকতে তার আঙ্গুলগুলো ব্যবহার করে থাকে। এই সময় যদি আপনি নতুন পোশাক পড়ে শিশুর সামনে যান সে হাত বাড়িয়ে আপনাকে আঙ্গুল দিয়ে ডাকার চেষ্টা করবে।
  1. চারটি দাঁত বের হয় : এগারো মাস বয়সে শিশুর মাড়িতে সাধারণত নিচের এবং উপরের অংশে একজোড়া সেন্ট্রাল ইনসিসার দেখা যায়। এই সময় শিশু হাসলে পরে অপরের এবং নিচের চোয়ালের দুটি ছোট ছোট সাদা দাঁত দেখা যায়। এই সময়ে চারটি ছোট দাঁত দেখা যাওয়া সত্ত্বেও শিশুরা শক্ত খাবার চিবানো থেকে দূরে থাকে, কেননা এই দাঁতগুলি প্রাথমিকভাবে চিবানোর চেয়ে কামড়াতে সহায়তা করে।
  1. বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং ভালো ঘুম : এগারো মাস বয়সে শিশুর অনেক দাঁত না থাকলেও বুকের দুধ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ শিশু বুঝতে পারে। এই সময় বাচ্চাকে একভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় না। কেননা এই সময় শিশুর আগের তুলনায় আরো বেশি খাবার প্রয়োজন। তাই কিছু পরিমাণ শক্ত খাবার দেওয়া হয়। তবে সঠিক খাবার দেওয়ার পাশাপাশি এই সময় শিশুর ভালো ঘুম দরকার। তা না হলে শিশুর বিকাশ যথাযথভাবে সম্পন্ন হবে না। তাই শিশুর রাতের বেলা ঘুমটা যাতে ভালো হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সামাজিক এবং সংবেদনশীল মাইলফলক

এই বিভাগে আমরা এগারো মাস বয়সী শিশুর আবেগময় স্বভাব এবং তার সাথে মানুষের সামাজিক বন্ধন, বিকাশের দক্ষতা সম্পর্কিত আলোচনা করব।

  1. পিতামাতাকে ‘মামা’ ‘দাদা’ বলে ডাকা : একটা সময় ছিল যখন শিশুটি সবাইকে এলোমেলোভাবে মামা বা দাদা বলে ডাকত। এখন এগারো মাস বয়সি শিশুটি জানে কে তার মা এবং কে তার বাবা। যে কারণে শিশুটি সঠিকভাবে তাদের সম্বোধন করতে পারে। এর পাশাপাশি অবিশ্বাস্য বিষয়টি হলো, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে শিশুটি তার মা-বাবাকে ডাকতে পারে। যেমন শিশুটির যদি খিদে পায় সে মামা বলে ডাকে। আবার যদি সে তার বাবার সাথে খেলে তখন দাদা বলে ডাকে।
  1. অপরিচিতদের মাঝে পরিচিত মুখ খোঁজ করে : হয়তো আপনি একটি অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়েছেন যেখানে আপনার শিশুকে সব আত্মীয়রা কোলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এই সময়ে শিশু তার পূর্ব পরিচিত দের সাথে বেশি সময় কাটাতে চেষ্টা করে। কেননা এগারো মাস বয়সের শিশুদের স্মৃতি খুব প্রখর হয়। তাই তারা নিজের প্রিয়জনদের ভালোভাবে চেনে। যে কারণে অচেনা লোকদের দেখলে সে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে কিংবা অচেনা লোককে দেখলে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। কেননা নতুন ব্যক্তিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিটিকে শিশু বিশ্বাস নাও করতে পারে, সে কারণে কোনো অনুষ্ঠানে একত্রিত হলে নিজের পরিচিত লোকের কাছেই শিশুকে রাখার চেষ্টা করুন। নইলে সে বিরক্ত হবে এবং তার মা-বাবাকে বিরক্ত করে তুলবে।
  1. হতাশা প্রদর্শন এবং মন খারাপ হয়ে যাওয়া : এগারো মাস বয়সী শিশুরা যে কোন অনুভূতি প্রকাশ করতে, তার অসন্তুষ্ট ভাব প্রকাশ করতে পারে। যেমন যদি কোনো শিশুর ঘুমানোর সময় হয়ে যায় কিন্তু আপনি যদি শিশুটিকে খেলার জন্য বিছানায় বসিয়ে রাখেন তখন সে বিরক্ত হয়ে যেতে পারে এবং তাকে সরানোর জন্য খেলনা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে যদি খেলনা বা বাধাপ্রাপ্ত জিনিসটি শিশু সরাতে না পারে সেক্ষেত্রে সে হতাশা প্রকাশ করে এবং বিরক্তি ভাব দেখায়।
  1. শিশু প্রথম অবাধ্যতা করে : এগারো মাস বয়স থেকেই শিশুরা দুষ্টুমি বাড়িয়ে তোলে। কোনও জিনিস জিজ্ঞাসা করলে তার নির্দেশাবলী বুঝতে পারে। যখন তার মন মতন উত্তর আসে না, তখন শিশুটি নির্দেশ উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। যেমন ধরুন শিশুটি তার খেলনা নিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছেন, সে ক্ষেত্রে আপনি যদি তাকে না বলেন তাতে সে ক্ষনিকের জন্য থামলেও পরে সেই খেলাটি ভাঙ্গার চেষ্টা করবে। কেননা এই সময় শিশু আগের তুলনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং দৃঢ়চেতা মানুষের মত হয়ে যায়। যার ফলে শিশুর মধ্যে অবাধ্যতা দেখা যায়।

এগারো মাস বয়সী শিশুকে কি ভ্যাকসিন দেওয়া হবে?

শিশুর জন্মের পর থেকে টিকাকরণ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সঠিক সময়ে সঠিক টিকাকরণের মাধ্যমে নানাবিধ মরণ ব্যাধি থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়। টিকাকরণের আবিস্কারের সাথে সাথেই আজ মারাত্মক এবং গুরুতর রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে। জন্মের পর থেকে শিশুর জন্য টিকাকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে পরিচালিত ইউনিভার্সাল টিকাকরন প্রোগ্রাম বিশ্বের বৃহত্তম জনস্বাস্থ্য কর্মসূচী। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর তিন কোটি গর্ভবতী মহিলা এবং ২.৬৭ কটি নবজাতককে শিশু স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর ৯০ লাখের বেশি টিকা দান করা হয়ে থাকে। ভারত সরকারের তরফে বারোটি অপরিহার্য টিকা সারাদেশে বিনামূল্যে দেওয়া হয়ে থাকে। ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও এবং হাম সহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ গুলোর টিকা এখানে রয়েছে।

এই মারাত্মক রোগ গুলোর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য জন্মের পর থেকেই শিশুদের বিভিন্ন ঔষধ টিকাকরণের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। এই ঔষধ গুলি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় আবার সরাসরি মুখেও দেওয়া হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের দুই ফোঁটা পোলিও ওষুধ দেওয়া হয়। এই ভ্যাকসিন গুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা বাড়াতে সহায়তা করে। তবে এই ধরনের ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে সংক্রমণ জনিত রোগ হয় না। শরীরে টিকাকরণের ফলে টি লিম্ফোসাইট এবং অ্যান্টি বডি তৈরি করতে পারে। টি লিম্ফোসাইট এবং বি লিম্ফোসাইট উৎপাদনের জন্য শরীরে টিকাকরণের পর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সেক্ষেত্রে টিকাকরণের সঙ্গে সঙ্গেই যদি কোনো রোগ কমে যাবে ভাবা  হয় সেটা কিনতু হবেনা। কারণ এটি শরীরে গিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে সময় নেয়। (5)
শিশুর জন্মের পর থেকেই পিতামাতাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো বাচ্চাদের টিকা দেওয়া। ভবিষ্যতে মারাত্মক রোগ থেকে বাঁচাতে এটি সহায়তা করবে এবং শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে আগের তুলনায় মারাত্মক রোগে বাচ্চাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ভারত আজ পোলিও ভাইরাস মুক্ত। ১৯৯০ সালে ভারতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১০০০ শিশু পোলিও ভাইরাসের কারণে অসুস্থ হতো। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে এই ধরনের আর কোন ঘটনা পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করে শিশুদের ভ্যাকসিন তৈরি করে।

তবে এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে শিশুদের ত্বকে এক ধরনের ব্যথা এবং লালচে ভাব দেখা দিতে পারে। তাই টিকাকরণ এর ফলে ব্যথার জন্য শিশুদের জ্বর আসতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে শিশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। তবে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় টিকাকরণ বিষয়টিকে অনেক বাবা-মা গুরুত্ব দেয় না, এই প্রক্রিয়াটি বেশ কিছু মারাত্মক রোগ কে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে সহায়তা করে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত যে রোগ গুলো মানুষকে ভাবাতো সেই সমস্ত রোগ নির্মূল করতে সহায়তা করে। যেমন, টিকাদান সারা বিশ্ব থেকে গুটি বসন্ত কে মুছে ফেলতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও বাচ্চাদের সঠিক সময়ে টিকা দিলে পরে পরিবারের সবাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে এবং শিশুর হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। নবজাতক শিশুদের টিকা করনের একটি নির্দিষ্ট সময় এবং নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। ভারতে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় বেশকিছু ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেওয়া হয়, যেগুলি জন্মের পর থেকে শিশুদের প্রয়োজনীয়।

শিশুদের পাঁচ ধরনের ভ্যাকসিন রয়েছে ক্ষুদ্রতর টিকা, নিষ্ক্রিয় টিকা, টক্সয়েড টিকা, সাবুনিট টিকা এবং কনজিগেট টিকা।
(5)
এগারো মাস বয়সের শিশুদের যে প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়া হয়  তা হল কনজিগেট ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন গুলো মূলত মামস, পক্স এই ধরনের সমস্যা গুলোর জন্য শিশুদের দেওয়া হয়ে থাকে। তবে শিশুদের টিকা দেওয়ার সময় পিতামাতাদের মাথায় রাখতে হবে টিকা দানের পর অনেক সময় শিশুদের শরীরে ব্যথা এবং তার থেকে জ্বর আসে। এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভ্যাকসিনের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেখানে শিশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। যেখানে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে সেই জায়গায় লালচে ভাব এবং ফোলা ভাব কমাতে কাপড়ে পেঁচিয়ে বরফ দিয়ে, ঠান্ডা জলে জায়গাটা স্পঞ্জ করে দিন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ব্যথা উপশমকারী মলম লাগাতে পারেন। এছাড়াও শিশুকে টিকা করনের পর প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাদ্য পান করান। কেননা টিকা দানের পর ২৪ ঘন্টা শিশুর শরীরে খাবারের অভাব দেখা দিতে পারে, কেননা টিকাকরণ এর ফলে শিশুর শরীরে যে অস্বস্তি হয় তার জন্য সে ঠিকমতো খাবার দাবার খায় না। এছাড়াও ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে কিছুদিন শিশুর ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দিন। উদ্বেগজনক কিছু লক্ষ্য করলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং যে জায়গাতে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে সেই জায়গাটি খোলা রাখুন। জায়গাটায় বাতাস লাগতে দিন। এতে দ্রুত ক্ষত নিরাময় হবে। ইনজেকশনের জায়গাটা জ্বালা ভাব হতে পারে সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ লাগান।

তবে টিকাকরণ না করার মত ভুল কখনোই করবেন না। এক্ষেত্রে শিশু মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হুপিংকাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকেন পক্স এর মতন সমস্যাগুলো শিশুকে সংক্রমণ করতে পারে। তাই শিশুর যথাযথ বিকাশের জন্য টিকাকরণ অত্যন্ত জরুরী।

এগারো মাস বয়সের শিশুর জন্য কত দুধের প্রয়োজন?

জন্মের পর থেকেই শিশুকে কেবলমাত্র মাতৃদুগ্ধ দেওয়া হয়। নবজাতক শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত কেবলমাত্র দুধের মধ্যে রাখা হয়। তারপর থেকে আস্তে আস্তে শিশুকে গোটা খাবার দেওয়া যেতে পারে। তবে এক বছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি শিশুদের বুকের দুধ পান করানো স্বাস্থ্যকর। এক্ষেত্রে এগারো মাস বয়সী শিশুকে দিনে সাত থেকে আটবার বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে। যদি পরিমান জানতে চান সেক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৩৮ আউন্স বুকের দুধ শিশুদের দেওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে দুধের পরিমাণ শিশুর স্বাস্থ্য এবং তার খিদের চাহিদার ওপরেই নির্ভর করবে। (6)

এছাড়া অনেক সময় দেখা যায় মায়েদের একটা সময় পর থেকে বুকের দুধ সঠিকভাবে তৈরি হয় না, সে ক্ষেত্রে শিশুকে যে খাবার দেওয়া হয় সেই খাবারের উপর নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে তাকে ফর্মুলা দুধ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দিনে পাঁচ থেকে ছয় বার শিশুকে ফর্মুলা দুধ দেওয়া যেতে পারে। যদিও এই ফর্মুলা দুধের পরিমাণ নির্ভর করবে শিশুর-স্বাস্থ্য অবস্থা এবং তাদের চাহিদার উপর। সুতরাং সম্পূর্ণটাই শিশুর ওপর নির্ভর করবে তার দৈনিক দুধের প্রয়োজনীয়তা।

এগারো মাস বয়সী শিশুর জন্য কত খাবারের প্রয়োজন?

শিশু বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তার খাবারের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। সে ক্ষেত্রে সঠিক খাবার দাবারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দৈনিক প্রত্যেকটি মাসে আলাদা আলাদা করে নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে শিশুকে খাদ্য দেওয়া উচিত। মূলত ছয় মাস বয়সের পর থেকে শিশুকে আস্তে আস্তে শক্ত খাবার দেওয়া হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে শিশুর যখন ১১ মাস বয়স হয়ে যায় তখন সে এক বছর পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে যায়। তখন তার খাবার প্রতি নজর দেওয়া উচিত। জেনে নিন এগারো মাস বয়সী শিশুকে কি কি খাবার কত পরিমাণে দেওয়া উচিত?

  • সিরিয়াল জাতীয় খাদ্য – সারাদিনে দশ চামচ পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।
  • ফল – আধা কাপ থেকে এক কাপ পর্যন্ত ফল দিনে তিনবার দেওয়া যেতে পারে।
  • সবুজ শাকসবজি – আধা কাপ সবুজ শাকসবজি দিনে তিন থেকে চারবার দেওয়া যেতে পারে।
  • দুগ্ধজাত দ্রব্য – যেমন দই, পনির জাতীয় খাদ্য ছোট কাপের অর্ধেক কাপ দই বা কয়েক টুকরো পনির দিনে দুবার দেওয়া যেতে পারে।
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার – যেমন ডিমের কুসুম, মুরগির মাংস দিনে এক থেকে দুই বার অল্প পরিমাণে দেওয়া যেতে পারে।
  • জল – সারাদিনে এক কাপ জল শিশুকে দিতে হবে।
  • ফলের রস – যেকোনো গোটা ফলের এক টুকরো শিশুকে হাতে দিন যদি চুষে খেতে পারে।

এগারো মাস বয়সের শিশুর কত পরিমান ঘুম দরকার?

শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রয়োজনীয় বস্তু হলো ঘুম। জন্মের পর থেকেই শিশু যত ঘুমাবে তার বিকাশ তত ভালোমতো হবে। সেক্ষেত্রে ঘুমের চাহিদা যথাযথ সম্পূর্ণ না হলে শিশুর বিকাশ থেমে যাবে। এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর দৈনিক রাত্রে এগারো ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এর পাশাপাশি দিনে দুবার তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত একেকটি ঘুম প্রয়োজন। ঘুম যাতে পর্যাপ্ত হয় সেটি মাকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা জন্ম থেকে প্রথম বছর শিশু যত ভালো করে ঘুমাবে তার বিকাশ ততো ভালো মতন হবে। এক্ষেত্রে শিশুর ঘুম পরিমাপের তুলনায় সামান্য কম বেশি হতে পারে। তবে মাথায় রাখতে হবে তার দৈনিক ঘুমের চাহিদাটা যেন পূরণ হয়। (7)

এগারো মাস বয়সী শিশুর জন্য খেলা এবং ক্রিয়া-কলাপ গুলি

এগারো মাস বয়সে এসে শিশুদের নতুন নতুন খেলনা নিয়ে খেলার ইচ্ছা হয়। তেমনি কয়েকটি খেলার সম্পর্কে জেনে নিন।

  1. জল রং করা – এই বয়সের শিশুরা নতুন নতুন রং দেখতে ভালোবাসে। যার ফলে তারা সেগুলো নিয়ে খেলতে চায়। তাই আপনার শিশুকে বিভিন্ন রং খেলতে দিন। একটা পাত্রে জল দিয়ে রং গুলে দিন এবং আপনার শিশুকে একটা ব্রাশ দিয়ে দিন এবং তাকে দেওয়ালে কিংবা খাতায় কিংবা কোন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তার নিজের খুশিমতো রং করতে বলুন। দেখবেন এতে শিশুটি আনন্দ পাবে এবং রং সম্পর্কে তার দৃষ্টিও তৈরি হবে।
  1. খাবার চেনা – আপনার শিশু আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে এই সময়ে সে ছোট ছোট শাকসবজি ফল গুলিকে চিন্তে শুরু করে। তাই যখন আপনি সবজি খাবেন আপনার শিশুকে পাশে নিয়ে বসুন এবং ছোট ছোট সবজিগুলো নিয়ে খেলতে সেগুলি তাকে হাতে দিন এবং সেগুলির আকৃতি সম্পর্কে শিশুকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। যেমন আপনি ধরুন আপনার শিশুকে কিছু খাওয়াচ্ছেন তখন তাকে কোন খাবার ধরতে দিন। যেমন মটরশুটি, ছোট ছোট গাজরের টুকরো এগুলো আপনার সামনে আলাদা আলাদা বাটিতে রাখুন এবং আপনার শিশুকে সেগুলো দিন এবং সেগুলো বিভিন্ন আকৃতির করে রাখুন। সেগুলি দিয়ে যেকোনো একটা ছবি তৈরি করুন যেমন টমেটো দিয়ে নাক তৈরি করলেন। নুডলস দিয়ে চুল তৈরি করলেন। গাজর দিয়ে চোখ তৈরি করলেন। এই ভাবে আপনার শিশুকে একটা মুখের আকৃতি সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করুন এবং পরে সেগুলো খেয়ে ফেলতে বলুন। এতে শিশুটি খাবারগুলো খেতে মজা পাবে এবং তার একটু খেলা হয়ে যাবে।
  1. বাদ্যযন্ত্র চেনা – এগারো মাস বয়স থেকে শিশুরা গান শুনলে তার সাথে সাথে পায়ে তাল দিতে পারে। তাই এই সময় যেকোনো কবিতা গান চালিয়ে শিশুর সামনে রাখুন। এতে শিশু মজা পাবে এবং ধীরে ধীরে সেটা শিখে যাবে। কিংবা বিভিন্ন কার্টুনের সিডি শিশুর সামনে চালিয়ে রাখুন। এতে শিশু সেগুলো দেখে আনন্দ পাবে এবং তার দৃষ্টি তৈরি হবে।
  1. রঙিন বই পড়া – শিশুর সামনে রং বেরঙের ছবি দেওয়া বই দিয়ে দিন, দেখবেন শিশুটি আনন্দের সাথে বই গুলো দেখবে এবং ছবি গুলিতে থাকা রংগুলি শিশুকে আকর্ষিত করবে। এতে শিশুটি মজা পাবে এবং নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারবে।
  1. ব্লক সাজানো – আপনার শিশুকে বিভিন্ন আকৃতির ব্লক দিন এবং সেগুলো নিয়ে একটা বড় টাওয়ার সাজাতে বলুন। দেখবেন প্রত্যেকটা ব্লক নিয়ে আপনার শিশুটি একটি বড় টাওয়ার তৈরি করার চেষ্টা করছে। খেয়াল রাখবেন এতে শিশুটি যেমন মজা পাবে তেমনই তার চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
  1. লাফানো – এমনিতেই ছোট ছোট বাচ্চারা লাফাতে খুব পছন্দ করে। এক্ষেত্রে খাটের ওপর লাফাতেই শিশুরা বেশি পছন্দ করে। তাই শিশুদের দাঁড়িয়ে খাটের উপরে লাফাতে উৎসাহ দিন। খাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনি শিশুটির পাশে থাকবেন এবং তাকে খাটের ওপরে উপর দিকে তুলে আবার খাটের উপর বসিয়ে দেবেন। এই সময় যদি আপনার শিশু হাটে তাহলে তাকে নিয়ে খাটের উপর লাফাতে সহায়তা করবেন। সে যদি নিজে নিজে লাফাতে যায় তার হাত দুটো ধরবেন, দেখবেন শিশুটি নিজের পায়ে শক্তি পাবে এবং নিজে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।
  1. বল খেলা – আপনার শিশুটি যদি হাতে যেকোনো জিনিস ধরতে সমর্থ হয়ে যায় তাহলে তাকে দিয়ে এই খেলাটি খেলতে পারেন। একটি কার্ডবোর্ড গোল করে নিয়ে তার ভেতর দিয়ে একপাশ থেকে বল ছুড়ে দিলে আরেক পাশে গিয়ে বল পড়বে এমন খেলাটি খেলতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কার্ডবোর্ড টি গোল করে নিয়ে তার ভেতর আপনার দিক থেকে বল ছুড়ে দেবেন যাতে আপনার শিশুর কোলে গিয়ে বলটি পড়ে, আবার শিশুকে শিখাবেন তার দিকে দিয়ে বলটা ছুড়ে দিতে যা আপনার দিকে এসে পড়বে। এই খেলাটি খেললে শিশু মজা পাবে এবং তার আনন্দ লাগবে।
  1. বাদাম ভাঙ্গা – এই বয়সী শিশুদের এই সমস্ত খেলাগুলি খুব প্রিয়। এক্ষেত্রে শিশুর সাথে আরেকজন সঙ্গী লাগবে। এক্ষেত্রে শিশুর বাবা-মা যদি পরস্পরের পিছনের দিকে বসে এবং শিশুকে শিখাতে হবে তাদের মাঝখানে এসে শিশুকে ঢুকে যেতে হবে। এই খেলাটি খেলার ফলে শিশুর একটা ভালো পেশী সঞ্চালনের হবে এবং মজা হবে।
  1. হামাগুড়ি খেলা – এই খেলায় দুজন লাগবে যারা পাশাপাশি সোজাভাবে মেঝেতে শুয়ে পড়বেন এবং শিশুকে দেখাতে হবে সে তাদের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠবে এবং নিচে নামবে। এই খেলাটি খেললে পরে শিশু মজা পাবে এবং তার শারীরিক পেশী সঞ্চালন হবে।
  1. বালিশ খেলা – এই খেলায় শিশুর আশেপাশে বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিন এবং শিশুকে শিখান বালিশ গুলোর উপরে তাকে লাফ দিয়ে উঠতে হবে। এই খেলা খেলার সময় অবশ্যই বড়রা শিশুর পাশে থাকবেন, কেননা এটিতে শিশুরা খেলতে মজা পেলেও হঠাৎ করে শিশুদের পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। (8)

এগারো মাস বয়সের শিশুদের পিতা মাতার সাধারণ স্বাস্থ্যের উদ্বেগ গুলি

আপনার ছোট্ট সোনা টি আজকাল একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে, সে আস্তে আস্তে হাঁটাচলাও শুরু করেছে তাই এই সময়টি শিশুদের বাবা-মাকে আরো সতর্ক ভাবে থাকতে লাগে। কেননা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া, ছোটখাটো আঘাত পাওয়া যেকোনো জিনিস এই সময় ঘটতে পারে। তাই জন্যে শিশুর দিকে সব সময় নজর রাখুন এবং বাড়ির যে জায়গা গুলোতে আপনার শিশুটি ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই জায়গাটি পুরোপুরি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। আপনার বাড়িতে যদি সিঁড়ি থাকে সেটা গেট দিয়ে আটকে রাখুন। যাতে আপনার শিশু হঠাৎ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে না যেতে পারে। যে সমস্ত বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র হাতের কাছে রয়েছে সেগুলো সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করুন। শিশুর হাতের নাগালে যদি কোনো ভারী জিনিস থাকে সেগুলো সরিয়ে রাখুন। যেকোনো ধরনের গরম জিনিস শিশুর থেকে দূরে রাখুন, যাতে সে হাত দিলে হাতে না পড়ে যায়। শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করুন এবং শিশুর প্রয়োজনীয় যেমন চিকিৎসক হাসপাতাল এই সমস্ত ফোন নাম্বার গুলো হাতের কাছে রাখুন। শিশুর সাথে খেলা করার সময় মনে রাখবেন শিশুর যাতে কোনরকম ক্ষতি না হয়, সেই বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। এই বয়সের শিশুদের বেশ কয়েকটি সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো সম্পর্কে জেনে রাখুন।

  1. ত্বকের এলার্জি – এইসময় শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা কোনো কিছুর সহায়তায় মেঝেতে কিংবা আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে শিশুর গায়ে যদি মশা কামড়ায় কিংবা কোনো কিছু লেগে যায় তার থেকে এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শিশুর চিকিৎসকের সাথে কথা বলে এলার্জির ঔষধ হাতের কাছে রাখুন। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে তা লাগিয়ে দিন।
  1. পড়ে যাওয়া – শিশু যখন একা ঘরে থাকবে তাকে কোনো উঁচু জায়গায় না রেখে বরং মেঝেতে বিছানা করে রাখতে পারেন। এতে শিশুর পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এছাড়া শিশু যখন হাঁটাচলা করার চেষ্টা করবে তখন তার সামনে থাকবেন, যাতে পড়ে না যায়। কেননা শিশুরা পড়ে গেলে তার থুতনিতে লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেজন্য সব সময় শিশুকে চোখের সামনে রাখবেন।
  1. পুড়ে যাওয়া – শিশু যেহেতু চুপচাপ বসে থাকতে চায় না তাই এদিক-ওদিক চলে যায় তাই শিশুর হাতের কাছে ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, ধূপকাঠি বা গরম খাবারের মতন কোন জিনিস রাখবেন না। কেননা তাতে যদি হঠাৎ করে শিশু হাত দিয়ে দেয় হাত পুড়ে যাওয়ার বা ফোস্কা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই শিশুর হাতের কাছে যাতে কিছু না থাকে সেই বিষয়টা নিশ্চিত রাখবেন।
  1. ডুবে যাওয়া বাড়িতে যদি বড় গামলা কিংবা চৌবাচ্চা থাকে কিংবা খোলা কুয়ো থাকে তবে অবশ্যই ঘরের দরজা বন্ধ রাখবেন। কেননা শিশু হঠাৎ করে হামাগুড়ি দিয়ে সেই দিকে চলে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাতে কিন্তু মারাত্মক সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তাই এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতন হবেন।
  1. বিষাক্ত করণ – ছোট শিশু যখন মাটিতে হামাগুড়ি দেয় তখন হাতে হঠাৎ কিছু নিয়ে তার মুখে দিয়ে দেওয়ার অভ্যাস থাকে। তাই ঘরবাড়ি সব সময় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন। কেননা কোনো খারাপ জিনিস যদি মুখে চলে যায় সেক্ষেত্রে শিশুর শরীরে বিষক্রিয়া হতে পারে। তার ফলে শিশু অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাই শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাতেই রাখুন।
  1. দম বন্ধ হয়ে যাওয়া – শিশু যখন খেলবে লক্ষ্য রাখবেন তার নাক-মুখ যাতে কোন কিছুতে ঢেকে না যায়। হঠাৎ কোন প্লাস্টিক জাতীয় বা কোন জিনিসে যদি শিশুর মুখ ঢেকে যায় সেক্ষেত্রে তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা হবে। তাই এই বিষয়গুলি নিয়ে সচেতন থাকুন।

শিশুর শ্রবণ, দৃষ্টি এবং অন্যান্য সংবেদন গুলি

১) আমার বাচ্চা কি দেখতে পারে?

জন্মের পর থেকেই শিশুর যখন বিকাশ হতে শুরু করে সে সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তেমনি জন্মের পর থেকেই একটু একটু করে শিশুর দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। সেখানে এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ বিকশিত হয়ে যায়। তখন শিশু সব জিনিস যেমন ভালো করে দেখতেও পারে, তেমনি সে চিনতেও পারে। তাই জন্য এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর দৃষ্টিশক্তি ভালোমতোই তৈরি হয়ে যায়।

২) আমার বাচ্চা কি শুনতে পারে?

শিশু ধীরে ধীরে যখন বড় হয়ে ওঠে তাঁর বোঝার এবং শোনার ক্ষমতাও বিকশিত হতে থাকে। সাত মাস বয়সের পর থেকেই শিশু সমস্ত শব্দ শুনতে পারে এবং তারপর আস্তে আস্তে শুনে ছোট ছোট শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এগারো মাস বয়সে এসে শিশু সবার কথা শোনার পাশাপাশি টিভি, রেডিও এই সমস্ত শব্দ ভালো মতো শুনতে পারে।

৩) আমার শিশু কি স্বাদ আর গন্ধ বুঝতে পারে?

সাধারণত অন্নপ্রাশন এর পর থেকেই ধীরে ধীরে শিশুরা তাদের খাবারের স্বাদ বুঝতে পারে। যে কারণে যেটা খেতে ইচ্ছা করে না সেটা অস্বীকার করে। এগারো মাস বয়সে এসে শিশু তার প্রত্যেকটি খাবারের স্বাদই ভালোমতো বুঝতে পারে। এমনকি খাবারের গন্ধ সম্পর্কেও বুঝতে পারে। তাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দুধের গন্ধ পেলেই শিশুরা না খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। অন্যদিকে মাছের ঝোলের গন্ধ পেলে কিংবা কোন চকলেট এর গন্ধ পেলে তা খাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে, এ মনটা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। (9)

শিশুর স্বাস্থ্য বিধি

এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর বেশ কিছু স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দেওয়া প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে শিশুর ত্বকের যত্ন, স্নানের যত্ন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, শিশুর পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখা এই ধরনের পদ্ধতিগুলি খেয়াল রাখতে লাগে। আসুন সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

  1. ত্বকের যত্ন – এগারো মাস বয়সের শিশুদের ত্বকের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন। এই সময় শিশুদের ত্বকে গরম গোটা, আমবাত, একজিমার মতন বিভিন্ন ত্বকের রোগ দেখা দিতে পারে। তাই শিশুর যত্নের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক জিনিস কিংবা শিশুদের পণ্য ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন। এই ক্ষেত্রে শিশুদের শ্যাম্পু, বডি লোশন, তেল এগুলো লাগানোর চেষ্টা করবেন এবং প্রত্যেকদিন শিশুকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন। যদি শীতের সময় স্নান না করতে পারেন তখন ওয়েট টিস্যু দিয়ে শিশুর সারা গা ভালো করে মুছিয়ে দেবেন।
  1. স্নানের যত্ন  – শিশুকে স্নান করানোর সময় লক্ষ্য রাখবেন তার নাক, কান, মাথার ত্বক, পায়ের ফাঁকে নোংরা জমে যেন না থাকে। ওইসব জায়গায় যদি নোংরা আটকে থাকে পরে শিশুর ত্বকের রোগ দেখা দেবে। তাই স্নান করার সময় স্নানের জলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে কিছু অ্যান্টিসেপটিক লোশন ব্যবহার করতে পারেন। তবে অবশ্যই তা শিশুর ত্বকে যদি সহ্য হয়।
  1. ডায়াপারের যত্ন – যারা শিশুকে নিয়মিত ডায়াপার পরান, তাদের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এটি পরিবর্তন করতে হবে এবং ডায়াপার খোলার পরে জায়গাটায় পাউডার ভালো করে দিতে হবে এবং মাঝে মধ্যে হাওয়া লাগাতে হবে। না হলে শিশুর নিম্নাংশে ফুসকুড়ি কিংবা র্যাসের মতো সমস্যা দেখা দেবে।
  1. পোশাক পরিষ্কার রাখা – শিশুর পোশাক ভালো করে এবং অ্যান্টিসেপটিক লোশন দিয়ে ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেবেন। শিশুকে কোনরকম ভেজা পোশাক পড়াবেন না এবং শিশুর বিছানা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন।
  1. ঘরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা – শিশুর ঘর সব সময় খোলামেলা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করবেন। প্রত্যেকদিন ঘর ঝাড়া মোছা করবেন এবং ঘরে যাতে পর্যাপ্ত রোদের আলো আসে সেই বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।

কিভাবে বাবা-মা শিশুর বিকাশে সহায়তা করতে পারে?

এগারো মাস বয়সে এসে আপনার শিশুটি এখন আগের থেকে অনেক বেশী পরিণত। আপনার শিশুকে তার বিকশিত হবার দিকে আত্মবিশ্বাস জোগাতে হবে বাবা-মাকে।

  1. এগারো মাস বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত খেলনা সরবরাহ করে এবং তার থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে মা-বাবাকে।
  1. এর পাশাপাশি এই সময় শিশুর অনেক কিছু সম্পর্কে জানার কৌতূহল জন্মায় যে কারণে তার হাত এবং চোখের সমন্বয়ে সবকিছু ধরতে চায়। সেই বিষয়গুলিকে বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে।
  1. শিশুর কৌতুহলতাকে  উৎসাহ দিতে হবে।
  1. বিভিন্ন খেলনা, চামচ, পাত্র, গৃহস্থালির বহু জিনিস এই সময় শিশুরা নিজের খেলার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করবে।
  1.  আপনার শিশু যেহেতু বড় হয়ে গেছে এখন আপনি তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন। বিভিন্ন পার্ক কিংবা বিভিন্ন মনোরঞ্জনের জায়গা শিশুর জন্য ঠিক করতে পারেন। এমন জায়গায় শিশুকে নিয়ে যাবেন যেখানে সে আরো নতুন জিনিস দেখতে পারবে এবং সেই জিনিস গুলো কে সে ধরে পরখ করতে পারবে।
  1. যদি কাছাকাছি বের হতে থাকেন তাহলে তাকে একা ঘুরতে দিন। নতুন জিনিস নিজে হাতে দেখতে দিন।
  1. অবশ্যই আপনি শিশুর পাশে থাকবেন। শিশুকে যখন মেঝেতে বসে খেলতে দেবেন তখন তার পাশে পাশে থাক বেন।
  1. শিশুর সাথে কথার ছলে নিজের ভাষা সম্পর্কে শিশুকে জানাবেন। শিশুকে কথা বলার জন্য উৎসাহ দেবেন।
  1. রঙিন ছবি, রঙিন বই দেখাবেন।
  1. গানের আকারে কবিতার সিডি গুলো পাওয়া যায় সেগুলি শিশুকে শোনাবেন।
  1. পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন।
  1. নতুন নতুন জিনিস দেখাবেন।
  1.  তবে অবশ্যই বাচ্চা যখন মাটিতে বসে খেলবে তখন যে কোনো ক্ষতিকর জিনিস বাচ্চার হাতের কাজ থেকে দূরে রাখবেন।

এই বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন দেখবেন আপনার শিশু ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে।

এগারো মাস বয়সী শিশুর বৃদ্ধির বিষয়ে বাবা-মাকে কখন চিন্তিত হওয়া উচিত ?

শিশু যখন এগারো মাস বয়সী হবে তখন যে বিষয়গুলি নিয়ে মা-বাবাদের চিন্তিত হতে হবে সেগুলি জেনে নিন :

  1. বাচ্চা যদি হামাগুড়ি না দেয় – প্রায় কুড়ি শতাংশ বাচ্চা হামাগুড়ি দেয় না। তাদেরকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে হাঁটানোর চেষ্টা করুন। তবে এক্ষেত্রে বাচ্চা যদি হামাগুড়ি না দেয় তবে বাবা-মায়েদের চিন্তা করতে হবে। চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে শিশুর স্নায়বিক পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে তার কোনো রকম শারীরিক বিকৃতি কিংবা স্নায়বিক ব্যাধি রয়েছে কিনা। অনেক সময় সেই সমস্ত সমস্যা থাকলে শিশুরা হামাগুড়ি দিতে পারেনা।
  1. শিশু যদি দাঁড়াতে না পারে – এগারো মাস বয়সে এসে একটি শিশু নিজে থেকেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে শিশুটিকে যদি উৎসাহ দেওয়া হয় সে কয়েকটি জিনিস ধরে কিংবা আপনার পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে যদি কোন কিছুর সহায়তা নিয়েও দাঁড়াতে সমস্যা হয় সে ক্ষেত্রে চিন্তার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে হতে পারে শিশুটি দাঁড়ালে তার পা দুটো নড়বড়ে, আলগা মনে হতে পারে কিংবা পায়ে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
  1. একটি শব্দও উচ্চারণ না করতে পারা – এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর শব্দের ভান্ডার খুব ভালো না থাকলেও মামা দাদা কাকার মত শব্দগুলো শিশুরা বলতে পারে। এমনকি মা বাবার কথা শুনে কিছু এলোমেলো শব্দ তারা বলতে পারে। তবে এক্ষেত্রে যদি আপনার শিশু কোনো শব্দই না করতে পারে তাহলে তা চিন্তার বিষয়। তাহলে অবশ্যই শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। হতে পারে স্নায়ুজনিত কোনো অসুস্থতার কারণে শিশু সঠিক বয়সে কথা বলতে পারছে না।
  1. সাড়া না দেওয়া – এগারো মাস বয়সে এসে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা মূলক জ্ঞানগুলি হয়ে যায়। এই সময় সে প্রাথমিক জিনিস গুলি উপলব্ধি করতে পারে। কেউ ডাকলে কিংবা একা থাকলে শিশুর অস্বস্তি হলে যে প্রতিক্রিয়াগুলো শিশু বোঝাতে পারে, এক্ষেত্রে আপনার সন্তান যদি এই ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়ায় উত্তর না দেয় তখন অবশ্যই আপনাকে চিন্তা করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  1. ইন্দ্রিয় গুলি দুর্বল হয় – শিশুকে যদি একটু দূর থেকে ডাকেন দেখবেন শিশুটি মাথা ঘুরিয়ে সেই দিকে তাকাচ্ছে। এক্ষেত্রে তার ইন্দ্রিয় গুলো যথাযথভাবে কাজ করছে। তবে এক্ষেত্রে যদি আপনার শিশু সঠিকভাবে উত্তর না দেয় কিংবা তার আচরণে যদি কোন দুর্বল ক্রিয়া-কলাপ দেখতে পান তবে হতে পারে শিশুটির কোন সমস্যা হচ্ছে। তবে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি মনে রাখবেন, অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন।

তবে শিশুর বাবা-মা অবশ্যই মনে রাখবেন প্রত্যেকটা বাচ্চাদের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে প্রত্যেকে একই সময়ে একই কাজ করবে তা নয় কারোর কোন কিছু আগে কিংবা কারোর কোন কিছু পড়ে হতে পারে। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে মানুষ করার সময় শিশুর পিতা মাতাকে ধৈর্যশীল হতে হবে এবং বাচ্চাকে স্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেতে সুস্থ মানুষ হওয়ার জন্য সহযোগিতা করতে হবে।

এগারো তম মাসের জন্য চেকলিস্ট

শিশু জন্মের পর থেকেই প্রত্যেকটা মাসের জন্য নির্দিষ্ট চেকলিস্ট মাসের শুরুতেই মা-বাবাদের করে রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলো কখনো ভুল হয়ে যায় না। এক্ষেত্রে এগারো তম মাসে শিশুর চেক লিস্টে যে বিষয়গুলো থাকবে সেগুলো হলঃ

  1. এগারো তম মাসে শিশুকে কবে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে সেই বিষয়টি নথিবদ্ধকরণ।
  1. শিশুর টিকা করনের দিনটি লিখে রাখুন।
  1. এগারো মাস বয়সী শিশুর ছবি তুলুন।
  1. আর এক মাস পর শিশুর এক বছর হবে সেই মাসের জন্য পরিকল্পনা করুন।
  1. শিশুর প্রথম জন্মদিনের পার্টি কিভাবে করবেন তা ঠিক করুন।

সচরাচর জিজ্ঞাস্য :

১) আপনার সন্তানকে সূত্র দেওয়া কখন বন্ধ করা উচিত?

শিশুর প্রথম জন্মদিনের পরেই আপনি আপনার বাচ্চাকে পুরোপুরি বা ২% গরুর দুধ দিতে পারেন। তবে এই সময়েও শিশুর মাতৃদুগ্ধ থেকে আসা পুষ্টিরও প্রয়োজন থাকে। যদি আপনি লক্ষ্য করেন গরুর দুধে শিশুর ডায়েরিয়া কিংবা পেটের সমস্যা হচ্ছে তবে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন এবং প্রয়োজনে মাতৃদুগ্ধ দিতে থাকুন।

২) এগারো মাস বয়সী শিশুর কতটি শব্দ জানা উচিত?

শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শব্দগুলো যেমন বাবা কাকা দাদা এই উচ্চারণ করতে পারে এবং যেকোন ডাক তারা বুঝতে পারে। শিশু এই সময় তার কাছের লোকের নাম জেনে যায়।

এগারো মাস বয়সে এসে দেখতে দেখতে আপনার সন্তান এক বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে। বলা যায় আর কদিন বাদেই একটি সম্পূর্ণ বছর পূর্ণ করবে আপনার ছোট্ট শিশুটি। এক্ষেত্রে শিশুটির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসবে। বাবা মাকে ধৈর্যের সাথে শিশুটিকে ধীরে ধীরে বড় করে তুলতে হবে। কেননা শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের অবদান সর্বত্র। তেমনই একটি সুস্থ শিশু বাবা-মায়ের কাছে ও দুর্মূল্য উপহার। তাই আপনার সন্তানকে সুন্দরভাবে বড় করে তুলুন। আজকের নিবন্ধ থেকে বাবা মায়েরা নিজের শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য বহু তথ্য পেয়েছেন। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে। এগারো মাস বয়সে এসে আপনার শিশু কি কি করছে সেটা আমাদের জানাতে ভুলবেন না। নিজেরা ভালো থাকবেন, আপনার ছোট্ট শিশুটিকে ভালো রাখবেন।

References

1) Infant growth chart By CDC
2) First Year Infant Development By American Pregnancy
3) A chart of infant By cog
4) Age-Appropriate Speech and Hearing Milestones By Hopkins medicine
5) vaccine
6) Feeding Guide for the First Year By urmc
7) Healthy Sleep Habits: How Many Hours Does Your Child Need? By healthy children
8) Child development 9–12 months By healthywa
9)Child development (4) – nine to 12 months By better health
Was this article helpful?
thumbsupthumbsdown

Community Experiences

Join the conversation and become a part of our vibrant community! Share your stories, experiences, and insights to connect with like-minded individuals.

Latest Articles