গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের শারীরিক লক্ষণ , শিশুর বিকাশ এবং শারীরিক পরিবর্তন – Eighth month pregnancy

Written by Surangama Chatterjee
Last Updated on

দেখতে দেখতে আপনি গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে পৌঁছে গেছেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে আর মাত্র কটা দিনের অপেক্ষা।

গর্ভধারণের প্রথম দিন থেকে শুরু করে সন্তান জন্ম দেওয়ার মাঝের এই কটা মাস স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকটা মহিলা একটা শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। আর প্রসবের সময় যত এগিয়ে আসে শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় গর্ভস্থ শিশু আকারে বড় হয়ে ওঠে এবং তার ক্রমাগত নড়াচড়া অনেক সময়ই হয়ত মায়ের শরীর অস্থির করে তোলে। একজন মায়ের পক্ষেও গর্ভাবস্থার শেষ কটা দিন শরীর নাড়ানো চড়ানো বেশ কষ্ট সাধ্য হয়। তবে এই কঠিন সময় এবং কম বেশি ভালো খারাপ অভিজ্ঞতা কাটিয়ে ওঠার পর আপনার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে এক অনাবিল আনন্দ, সন্তান জন্মের মুহূর্ত।

অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় আপনি যে যে অভিজ্ঞতা গুলির সম্মুখীন হবেন

অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় আপনি যে যে অভিজ্ঞতা গুলির সম্মুখীন হবেন সেগুলি হলো নিম্নরূপ –   (1) (2) (3)

  • ওজন বৃদ্ধি – এটা নির্ভর করে মূলত বিএমআই  এর ওপর (4)
গর্ভাবস্থার সময়বিএমআইবিএমআই  ২৫-৩০বিএমআই > ৩০
  ৮ ম ৮-৯ কিগ্রা ৫-৬ কিগ্রা ৪-৫ কিগ্রা
  • শ্বাসকষ্ট ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদার উপর জরায়ুর চাপ শ্বাস-প্রশ্বাস কে কঠিন করে তোলে।
  • ক্লান্তি গর্ভস্থ ভ্রুণের আয়তন বৃদ্ধির জন্য অল্পেতেই শরীর ক্লান্ত হয়ে ওঠে।
  •  নাক বন্ধ ইস্টোজেন ক্ষরণের মাত্রা বৃদ্ধিতে নাসিকা ঝিল্লি প্রশস্ত হয়ে যায়। ফলে বেশি মিউকাস নাসারন্ধ্র দিয়ে নাসিকা গহ্বরে প্রবেশ করে।এবং নাক বন্ধ ভাব অনুভূত হয়।
  • বুক জ্বালা বা হার্ট বার্ন ক্রমবর্দ্ধমান জরায়ু পাকস্থলীকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড ইসোফেগাসের মধ্যে প্রবেশ করে এবং একটা অস্বস্তিকর জ্বালাভাব অনুভূতির সৃষ্টি করে।
  • ফোলা ভাব বা ব্লটিং এই সময় প্রজেস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে পরিপাক বা হজম প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে যায়। এবং পেট ফেঁপে যায় আর পেটে গ্যাসীয় পদার্থ ভরে যায়।
  • কোষ্ঠ্য কাঠিন্য  – হজম প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে যাওয়ার ফলে অন্ত্রে খাদ্য দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থাকে। পরিণাম স্বরূপ কোষ্ঠ্য কাঠিন্য দেখা যায়।
  • ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন তলপেটে অনূভূত হওয়া একটা ব্যথাহীন সংকোচন। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা লক্ষণ যা প্রসবের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।
  • অর্শ রোগ ক্রমবর্দ্ধমান জরায়ুর চাপে ভেনা কাভা (শরীরের বৃহত্তম শিরা) রক্ত প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। ফলে শিরায় রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যা মলদ্বার অঞ্চলের কাছাকাছি রক্তনালীর সম্প্রসারণ ঘটায়। ফলস্বরূপ ব্যথা যন্ত্রনা এবং চুলকুনির সৃষ্টি হয়।
  • বর্দ্ধিত শিরা প্রসারিত জরায়ুর কারণে ভেনা কাভায় রক্ত প্রবাহে চাপের সৃষ্টি হয়। ফলে পায়ের শিরায় রক্ত প্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হয় এবং রক্ত নালিকা গুলিকে সম্প্রসারিত করে তোলে। এটা বর্দ্ধিত শিরা নামে পরিচিত।
  • এডিমা বা শোথ শরীরের জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে গোড়ালি এবং পা ফুলে যায়।
  • পিঠ ব্যথা ক্রমবর্দ্ধমান জরায়ু শরীরের নীচের দিকে চাপ সৃষ্টি করলে পিঠের ব্যথা দেখা যায়।
  • অনিদ্রা বার বার শৌচালয়ে যাওয়ার জন্য এবং একটা শারীরিক অস্বস্তির ফলে শান্তিতে ঘুম বিঘ্নিত হয়।
  • পায়ে খিঁচ ওজন বৃদ্ধি, শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের ঘাটতি, অতিরিক্ত সক্রিয় এবং নিস্ক্রিয় শরীর পা খিঁচ ধরার জন্য দায়ী।
  • যোনিস্রাব বৃদ্ধি গর্ভবস্থায় জরায়ু এবং যোনীর দেওয়াল নরম হয়। যার ফলে সাদা স্রাব নিঃসৃত হয়। এই সাদা স্রাব যোনীপথে জরায়ুতে কোনো ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশে বাধা প্রদান করে।
  • তলপেটে চাপ এই সময় গর্ভস্থ ভ্রুণের আয়তন বৃদ্ধির ফলে তলপেটে অতিরিক্ত চাপ অনুভূত হয়।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে শারীরিক পরিবর্তন

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের মধ্যে শরীরে একাধিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ কিছু পরিবর্তণের ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা হলো –

  • গর্ভধারনের অষ্টম মাসে পেটের স্ফীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় থেকেই গর্ভস্থ শিশুটির মাথা নীচের দিকে নেমে আসে।
  •  হরমোনের পরিবর্তনজনিত কারণে চুল ওঠা অনেকটাই কমে যায় এই সময়। যার ফলে মাথায় চুল কম এমনটা মনে হয়না।
  •  এই সময় স্তন থেকে কোলোস্ট্রাম নামক একটি হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ নির্গত হয়। এই দুধই মা প্রথম তার শিশুকে পান করায়।
  •  হরমোনের পরিবর্তনজনিত কারণে পিগমেন্টেশান হয় যার ফলে স্তন বৃন্ত গাঢ় রঙের হয়ে যায়।
  •  জরায়ুর স্ফীতির ফলে ত্বকে স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগের সৃষ্টি হয়।
  •  তলপেটের নিম্নাংশ থেকে পিউবিক হেয়ার লাইন (যোনীকেশ রেখা) এর মধ্যেকার কালো রেখা আরো গাঢ় বর্ণের হয়ে যায়।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে শিশুর বিকাশ

অষ্টম মাস অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ২৯-৩২ সপ্তাহ। এর মধ্যে শিশুর ভ্রূন অবস্থা থেকে মোটামুটি দেহাবয়াব গঠিত হয়ে যায়।

শিশুর ওজন – ১ কিলো ১৫৩ গ্রাম – ১ কিলো ৭০২ গ্রাম

শিশুর সিআরএল (ক্রাউন র‍্যাম্প লেন্থ) – ১৫.১৯ – ১৬.৬ ইঞ্চি  (৩৮.৬ – ৪২ সেমি)

অষ্টম মাসে শিশুর দেহাংশ ভেদে বিকাশ – (5) (6) (7)

দেহের অংশবিকাশ
চোখখোলা এবং বন্ধ করা শুরু হয়
ফুসফুসগঠন সম্পূর্ণ রূপে না হলেও শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
চুলগজাতে শুরু করে
হাড়গঠন সম্পূর্ণ হলেও নরম থাকে
কিডনি / বৃক্ক সম্পূর্ণ ভাবে গঠিত হয়ে যায়
ত্বককম কোঁচযুক্ত
নখহাত এবং পায়ের আঙুলের তালু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
পাচন তন্ত্রগঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
কানশব্দ শুনতে সক্ষম। তবে অন্য সকলের আওয়াজের থেকে মায়ের আওয়াজ বা মহিলাদের আওয়াজ শুনতে পছন্দ করে।
স্নায়ুতন্ত্রগঠন প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গের কাজকর্ম পরিচালনা করতে শুরু করে।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে প্রসবের সময় যত এগিয়ে আসে গর্ভে আপনার শিশুর সঠিক অবস্থান এবং বিকাশ সম্বদ্ধে জেনে নেওয়া দরকার।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের পরিচর্যা

গর্ভাবস্থার শেষ কটা মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়। এই সময় গর্ভবতীদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার। একজন গর্ভবতীর খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন প্রণালী গর্ভস্থ শিশুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই এইসময় আসন্ন প্রসবা মায়ের দেখাশুনো একটু বেশি গুরুত্ব সহকারে করলে মা এবং শিশু দুজনের স্বাস্থ্যের জন্যই ভালো বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা মাথায় আসে সেটা হলো গর্ভবতী মহিলার আহার। এই সময় একজন গর্ভবতী মহিলা কী কী ধরণের খাদ্য গ্রহণ করবেন যা তার স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী সে বিষয়ে জেনে নেওয়ার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিৎ। চিকিৎসক গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তালিকা তৈরী করে দেবেন।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের খাদ্য তালিকা

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের খাদ্য তালিকা গর্ভবতীর জন্য খুবই জরুরী একটি জিনিস। নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস, গ্রহণ মা এবং গর্ভস্থ শিশু দুজনের জন্যই উপাদেয় বলে বিবেচিত হয় (8)

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে খাদ্য তালিকায় যে যে জিনিস গুলি থাকা প্রয়োজন

  • ভিটামিন এবং মিনারেলস বা খনিজ পদার্থ যুক্ত খাদ্য সমূহ 

যেহেতু প্রসবে আর মাত্র কটা দিনের অপেক্ষা তাই এই সময় খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থযুক্ত খাদ্য সমূহ পর্যাপ্ত মাত্রায় থাকা জরুরী। এই সময় ক্যালসিয়াম এবং আয়রন বেশি মাত্রায় সেবন করা দরকার। কারণ প্রসবের সময় রক্তপাত হয় তাই যাতে রক্তাল্পতার সমস্যা দেখা না যায় সেই জন্য শরীরে আয়রনের অধিক পরিমাণ উপস্থিতি থাকা দরকার। শরীরে আয়রণের মাত্রা বজায় রাখার জন্য সবুজ শাক সবজি, বাদাম, দুগ্ধজাত দ্রব্য খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

  • কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং চর্বিযুক্ত খাদ্য 

এই সময় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, এবং চর্বি সমন্বিত খাদ্য খাওয়া উচিৎ। এই সব উপাদান সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে শিম, মুরগির মাংস, দুধ, ডিম, মিষ্টি আলু, কম পারদ যুক্ত মাছ, সয়া দুধ, টফু, শুকনো বাদাম ইত্যাদি।

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার 

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এই খাবার কোষ্ঠ্য কাঠিন্যের সমস্যা থেকে শরীরকে মুক্ত রাখে। ফাইবার যুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে ওটস, ফল, গমের আটার রুটি এবং পাউরুটি, অ্যাভোকাডো, এবং সবুজ শাক সবজি।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে যে যে খাদ্য গুলি গ্রহণ করা উচিৎ নয়

  • কফি বর্জন করুন গর্ভাবস্থায় ক্যাফাইন যুক্ত খাবার না খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদি আপনি আসক্ত হন, চা বা কফি পানের একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে নূন্যতম পরিমাণ গ্রহণ করুন। কারণ অতিরিক্ত ক্যাফাইন গ্রহণ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শুধু চা বা কফিই নয় চকোলেট গ্রহণ থেকেও বিরত থাকা উচিৎ।
  • গাঢ় পাস্তুরাইজড দুধ – গর্ভাবস্থায় পাস্তুরাইজড দুধ পান করা উচিৎ নয়। কারণ এতে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতির সম্ভবনা থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
  • উচ্চ মাত্রায় পারদযুক্ত মাছ গর্ভাবস্থায় মাছ খাওয়া উপকারী কিন্তু মাথায় রাখা দরকার যে উচ্চ পারদ যুক্ত মাছ যেনো অসাবধানতা বশতও খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত না হয়। হাঙর, কিং ম্যাকারেল নামক মাছ গুলি এই সময় বর্জন করা উচিৎ।
  •  নরম পনির –  নরম পনির খাওয়া একদমই উচিৎ নয় এই সময়। কারণে এতে রয়েছে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাক্টেরিয়া যা গর্ভাবস্থায় খুবই ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হয়।
  • কাঁচা ডিম, কাঁচা মাংস, এবং লিভার  – কাঁচা বা কম রান্না করা ডিম, মাংস এবং লিভার গর্ভাবস্থায় একেবারেই খাওয়া উচিৎ নয়। কারণ এতে সালমোনেলা নামক ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় যা খাদ্যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
  • অ্যালকোহল বা তামাক – প্রত্যেক মানুষের জন্যই এই জিনিস গুলি ক্ষতিকারক। তবে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এই জিনিস গুলি সেবন একেবারেই উচিৎ নয়।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের শারীরিকচর্চা, ব্যায়াম

যে কোনো মানুষের জন্যই শরীর চর্চা দরকারী। আর গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে শারীরিক চর্চা বিশেষত ব্যায়ম তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এতে মা এবং গর্ভস্থ শিশু দুজনের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে। শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য বলেই নয় মানসিক স্বাস্থ্যও বেশ চনমনে থাকে। এই সময় এমন ব্যয়ম কয়া উচিৎ যা পেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেনা। এই সময় আপনি অল্প সময় হাঁটা চলাওও করতে পারেন। একজন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে স্ট্রেচিং করতেও পারেন। শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ম ও করা যায় এইসময়। তবে যে কোনো রকম শরীর চর্চা করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার (9)

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে জন্য প্রয়োজনীয় স্ক্যান এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা

গর্ভাবস্থায় মা এবং গর্ভস্থ শিশুর যে কোনো রকম শারীরিক সমস্যা এড়াতে নিয়মিত ডাক্তারী পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এতে গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্যের হালহকিকত তো বতেই এমনকি শিশুর বিকাশ এবং স্বাস্থ্যের বিষয়েও জানতে পারা যায়। গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে কী কী শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এবার সেগুলি জেনে নেওয়া যাক –

  • গ্রোথ স্ক্যান গর্ভাবস্থার শুরুর মাসগুলির মতন আল্টা সাউণ্ডের সাহায্যে শিশুর বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই পরীক্ষার দ্বারা শিশুর কার্যকলাপ, গর্ভে শিশুর অবস্থা, অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ এবং গর্ভনালী বা উম্বিলিকাল কর্ডের অবস্থা দেখা হয়।
  • নন স্ট্রেস টেস্ট গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে এই পরীক্ষা করা হয়। এটি শিশুর হৃদস্পন্দন এবং নড়াচড়া পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষার সময় কোনো ধরণের শারীরিক অস্বস্তি বা কষ্ট ও যন্ত্রনা হয়না তাই একে নন স্ট্রেস টেস্ট বলা হয়।

এছাড়াও প্রতিবারের মতন এবারেও আপনার ওজন এবং রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার

এই সময় যেসব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ সেগুলি হলো নিম্নরূপ –

  • দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিরত থাকুন।
  •  শিশু কতবার পেটে লাথি মারছে তার একটা তালিকা বজায় রাখুন। যদি বেশ কিছুটা সময় শিশুর নড়াচড়া টের না পাওয়া যায় তাহলে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করুন কারণ মিষ্টি বিশেষত চিনি শিশুকে সক্রিয় করে তোলে এবং শিশু নড়াচড়া করতে শুরু করে দেয়।
  • মানসিক চাপ এবং দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন।
  • ধূমপান এবং অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকুন।
  • শরীর আর্দ্র রাখতে প্রচুর পানীয় পান করতে হবে।
  • শরীরকে যথেষ্ট পরিমান বিশ্রাম দেওয়া দরকার।
  • এইসময় চিৎ হয়ে শোওয়া উচিৎ নয়।
  • ওরাল হেলথ বা মুখ গহ্বরের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হবে।
  • অল্প সময়ের বিরতিতে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
  • ভারী ওজন তোলা বর্জনীয়।
  • পেলভিক পেশী কে মজবুত করার জন্য এইসময় হাঁটাহাঁটি করা এবং কেজেল এক্সারসাইজ করা দরকার।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন বাঞ্ছনীয় নয়।
  • আরাম দায়ক চটি, জুতো পরুন এবং ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান করুন।
  • বিড়ালের বর্জ্র্য পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকুন কারণ এটি টক্সোপ্লাজমোসিস ঘটাতে পারে।
  • রাসয়নিকের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসের মানসিক স্বাস্থ্য, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা

এইসময় গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের মাস গুলির সাথে কিছুটা হলেও গর্ভবতী মহিলার চিন্তা ভাবনা গত মিল পাওয়া যায়।

  • অকাল প্রসব যদি কোনো গর্ভবতী মহিলার দুশ্চিন্তা , উদ্বেগ ইত্যাদি সংক্রান্ত পূর্ববর্তী সমস্যা থাকে তাহলে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই প্রসবের সম্ভবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নির্ধারিত সময়ের জন্ম গ্রহণের কারণে শিশুর ফুসফুস অপরিণত থাকে তাই শিশুটিকে নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ) রাখতে হয়।
  •  উচ্চ রক্তচাপ গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে কম বেশি সকল গর্ভবতী মহিলার উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা যায়। তবে কিছু মহিলার ক্ষেত্রে অষ্টম মাসে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কিছুটা হলেও বেড়ে যেতে দেখা যায়। তবে যেসব মহিলার গর্ভধারণের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী রক্তচাপ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়।
  • প্রি এক্লাম্পসিয়া কিছু গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে এই সমস্যাও দেখতে পাওয়া যায়। প্রি এক্লাম্পসিয়া হলো সেই অবস্থা যখন গর্ভবতী মহিলার রক্তচাপ অনেকটাই বেড়ে যায় এবং তার সাথে প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।  এই রকম কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার।

হবু বাবার জন্য কিছু পরামর্শ বা টিপস

হবু বাবার জন্য এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয় কারণ এই সময়ই সে তার অনাগত সন্তানের জন্য অনেক রকম ভবিষ্যত পরিকল্পনা করে রাখে। এখানে হবু বাবার সুবিধার্থে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো-

  • সন্তানের ভবিষ্যত পরিকল্পনা এই সময় আপনার অনাগত সন্তানের জন্য ভবিষ্যত পরিকল্পনা করে রাখার উপযুক্ত সময়। বাচ্চার ভবিষ্যতের জন্য কিভাবে এবং কোথা থেকে সংসার খরচা বাঁচিয়ে বা রোজকার বাড়িয়ে টাকা পয়সার সাশ্রয় করা যাবে সেসব ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করে রাখুন সন্তান জন্মের আগের কটা দিন।
  •  গর্ভবতী মহিলাকে সাহস জোগানো –  প্রসবের দিন যত ঘনিয়ে আসবে প্রসব কে কেন্দ্র করে গর্ভবতী মহিলার দুশ্চিন্তা তত বৃদ্ধি পাবে। এইসময় তার মনের জোর বৃদ্ধি করে রাখা খুব দরকার। হবু মা কে বলা দরকার যে সে খুবই সাহসী। এই সময় হবু মা বেশি ভয় পেলে সন্তানও মানসিক ভাবে দুর্বল হবে।
  • গর্ভবতী মহিলাকে গৃহস্থালীর কাজে সহায়তা –  ঘরের কাজে আপনার স্ত্রীকে সাহায্য করুন। আপনি রান্নার কাজ নাই জানতে পারেন তাহলে সেক্ষেত্রে ঘর পরিষ্কার এবং সংসারের অন্যান্য কাজে স্ত্রীকে সহায়তা করুন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় আমাকে কতটা ওজন বৃদ্ধি করতে হবে?

উঃ গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে  ১ কিলো ৫০০ গ্রাম – ২ কিলো ওজন বৃদ্ধিকে যৎসামাণ্য বলে মনে করা হয়। সেটা আপনি গর্ভাবস্থার ওজন বর্দ্ধক তালিকা বা প্রেগন্যান্সি ওয়েট গেন ক্যালকুলেটার দেখলেই বুঝতে পারবেন। যদি আপনি শারীরিক ভাবে সুস্থ্য সবল হয়ে থাকেন তাহলে গর্ভাবস্থায় মোট ১১ কিলো ৫০০ গ্রাম থেকে ১৬ কিলো পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাসের পর থেকে প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পায়।

গর্ভাবস্থায় শিশুর ওজন কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়?

উঃ- গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য এবং ওজন উভয়ই গর্ভবতীর খাদ্যের ওপর নির্ভর করে। গর্ভবতীর খাদ্য সরাসরি শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলে। গর্ভস্থ শিশুর ওজন বৃদ্ধি করতে হলে গর্ভবতী মহিলাকে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন, ক্যালসিয়াম, এবং প্রোটিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

আমি কখন আমার বাচ্চার লাথি অনুভব করবো?

উঃ- গর্ভাবস্থার ৪র্থ মাস থেকেই শিশু গর্ভে লাথি মারতে শুরু করে। তবে প্রথম দিকে এই লাথি অনুভব করার জন্য আপনাকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। তারপর সময়ের সাথে সাথে এটা অনুভব করা সহজ হয়ে যাবে।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে বাসে ভ্রমন করা কী নিরাপদ?

উঃ- না, এই সময় বাসে ভ্রমণ নিরাপদ নয়। হয়ত রাস্তা অসমান, বা খানাখন্দ রয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে ঝাঁকুনি লেগে যেতে পারে। যা গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই বিপদজনক হতে পারে।

গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে যৌনমিলন করা উচিত কী?

উঃ- গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে যৌন মিলনে লিপ্ত হওয়া যেতেই পারে। তবে আপনার যদি কোনোরকম শারীরিক সমস্যা যেমন রক্তস্রাব, প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া (নিম্নমুখে আসার প্রবণতা) ইত্যাদি সমস্যা হয় তাহলে যৌন মিলন এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়।

অষ্টম মাস, গর্ভাবস্থার একদম শেষের পর্যায়। এই সময় গর্ভবতী মহিলার অনেক যত্নের দরকার। গর্ভবতী মহিলার সঠিক যত্ন এবং পরিচর্যার ফলে শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশ ভালো হয়। অষ্টম মাসের গর্ভাবস্থায় মহিলাদের জন্য অবশ্য পালনীয় কার্যকলাপ, শরীর চর্চা, খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে ওপরিক্তো নিবন্ধে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।

References

1. Stages of pregnancy by womenshealth.gov
2. Pregnancy: Hemorrhoids and Constipation by HealthLinkBC
3. What happens in the eighth month of pregnancy? by Planned Parenthood Federation of America Inc. (2019)
4. Fact Sheet Gestational weight gain – by NSW
5. Third Trimester Fetal Development by Sutter Health (2018)
6. Prenatal Form and Function – The Making of an Earth Suit by The Endowment For Human Development, Inc (2001-2019)
7. Fetal development   by NIH (2019)
8. Pregnancy and diet by Better Health Channel
9. How active should I be in pregnancy? By Tommy’s
Was this article helpful?
thumbsupthumbsdown

Community Experiences

Join the conversation and become a part of our vibrant community! Share your stories, experiences, and insights to connect with like-minded individuals.

Latest Articles