গর্ভাবস্থায় ঘুমানোর সঠিক উপায় কী? | How to Sleep in Pregnancy in Bengali
In This Article
গর্ভাবস্থায় অনেক মহিলারই ঘুমোনোর ক্ষেত্রে সমস্যা হয় , সঠিক ভাবে বা সঠিক পরিমানে ঘুম হয় না। আর এই সময়েই প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের। তাই আপনাদের এই সমস্যা দূর করার জন্য আমাদের এই প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হল।
কেন গর্ভাবস্থায় ঘুমাতে অসুবিধা হয় ?
গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হওয়া বহু মহিলারই সমস্যা। জানা যায় 66 থেকে 94 শতাংশ গর্ভবতী মহিলারা এই সমস্যায় ভোগেন পিঠে ব্যথা , ঘন ঘন বাথরুম পাওয়া , পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি কারণের জন্য (1)। তবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কে আমরা আপনাকে জানাবো।
গর্ভাবস্থায় কতটা ঘুম যথেষ্ট?
আমাদের সবারই দিনে আট ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। তেমনি কোনো গর্ভবতী মহিলারও দিনে আট ঘন্টা ঘুমোনো উচিত। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ও শেষের দিকে অনেক মহিলাই ক্লান্তি অনুভব করে থাকেন, তাই ক্লান্তি লাগলে বিশ্রাম নেওয়া উচিত। কিন্তু আট ঘন্টার বেশি ঘুমোবেন না।
ঘুমের অভাব কি গর্ভের শিশুর ক্ষতি করে?
হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। গর্ভাবস্থায় ঘুমের অভাব গর্ভস্থ শিশুর ঠিক কি কি ক্ষতি করতে পারে, তা নিচে উল্লেখ করা হল (1) (2)।
- সময়ের আগে প্রসব হতে পারে, তাই বাচ্চা প্রিম্যাচিউর হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- বাচ্চার ওজন সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। জন্মানোর সময় বাচ্চার ওজন কম হতে পারে।
এছাড়া গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে ঘুমের অভাবে প্রসব যন্ত্রনা বৃদ্ধি পেতে পারে, অস্বস্তি বোধ বেড়ে যায় শরীরে ও সি-সেকশন দ্বারা বাচ্চা প্রসবের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় (2) ।
জানুন গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার কারণ ও তার সমাধান সম্পর্কে
প্রথম ট্রাইমেস্টার
- ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া – গর্ভাবস্থায় শরীরে প্রজেস্টেরন হরমোন বৃদ্ধি পায় (3)
এবং এই কারণেই ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয় গর্ভবতী মহিলাকে। এছাড়া এই অবস্থায় জরায়ুর আকার বড় হতে থাকে ও তার ফলে মূত্রাশয়ে চাপ পড়ে। ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
সমাধান– আপনি যদি ঘুমন্ত অবস্থায় বার বার বাথরুমে যেতে যেতে ক্লান্ত বোধ করেন,
তাহলে দিনের বেলায় বেশি পরিমানে জল খান, রাতে অল্প পরিমানে খান। ক্যাফিন
জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলুন।
- বমি বমি ভাব – হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই সময়ে বমি বমি ভাব হয়ে থাকে, যা রাত্রে ঘুমোনোর সময়ও হতে পারে ও যার জন্য ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
সমাধান– নানা ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে আদা অনেকের ক্ষেত্রে
এই সমস্যা দূর করে। প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভুলবেন না।
- স্ট্রেসের জন্য– গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে হরমোনের তারতম্যের জন্য অনেক গর্ভবতী মহিলাই স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে যান। যার প্রভাব পরে তার ঘুমের ওপার, বার বার ঘুম ভেঙে যায়।
সমাধান – ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটু শান্ত হয়ে বসুন বা শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করুন। এছাড়া ঘুমোতে যাওয়ার আগে গরম দুধ খেতে পারেন বা ঈষৎ উষ্ণ জলে গা ধুয়ে নিতে পারেন। সুমধুর গান চালিয়ে ঘুমোতে যেতে পারেন। হালকা ধরনের রিল্যাক্স করার মতো কিছু ব্যায়ামও করতে পারেন। অবশ্যই এ সম্পর্কে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার
- বুকে বা পেটে অস্বস্তি বোধ করা – আপনি আপনার গর্ভাবস্থায় যে কোনও সময় অম্বল বা বুক জ্বালায় আক্রান্ত হতে পারেন।রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় এটি আরও বেশি ঘটে বলে জানা যায় । এর কারণ হল গর্ভাবস্থায় হরমোনগুলি এমন কিছু পেশীকে শিথিল করে যার ফলে পাকস্থলীতে তৈরী হওয়া অ্যাসিড গলনালীর দিকে চলে আসে।এছাড়াও জরায়ুর আকার বৃদ্ধিতে পাকস্থলীর ওপর চাপের সৃষ্টি হয়।
সমাধান – খাবার খাওয়ার পরই শুতে যাবেন না। খাবার ভালোভাবে হজম করার সময়
দিন শরীরকে। ভাজা পোড়া জাতীয় খাদ্য কম খান। নিয়মিত যোগব্যায়াম করার চেষ্টা
করুন। তবে এ সম্পর্কে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
- লেগ ক্র্যাম্পস বা পায়ে খিঁচুনি ধরা – গর্ভাবস্থায় দিনের যেকোনো সময় আপনি এই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। কিন্তু রাতে এর সমস্যা বেশি দেখা যায়। অতিরিক্ত ওজন বহন করার সাথে সাথে পায়ের পেশীর সংকোচন ও ক্লান্তির কারণে সম্ভবত ক্র্যাম্প বা খিঁচুনিগুলি ঘটে।
সমাধান – সাধারণত ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণে পায়ে খিঁচুনি হয়ে থাকে। আপনি আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে এর পরিপূরক গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে পারেন।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার
- বাচ্চার নড়া–চড়া – তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে গর্ভস্থ শিশু অনেকটাই বড়ো হয়ে যায় ও নড়তে চড়তে শুরু করে। আর গর্ভবতী মহিলার ঘুমের সময় এরম ঘটলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
সমাধান – এই সমস্যার সমাধানের জন্য আপনাকে শোওয়ার ধরণে পরিবর্তন আনতে
হবে, যা সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হবে।
- পিঠে ব্যথা – গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি ও হরমোনের তারত্যমের জন্য পিঠে ব্যথা হয়ে থাকে। এই ব্যথার কারণে অনেক মহিলারই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে থাকে।
সমাধান – এই সময় পেশী শিথিল হয়ে যায়, তাই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে হালকা
ধরণের যোগব্যায়াম করতে পারেন।
আর কি কি কারণে গর্ভাবস্থায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে থাকে ?
- শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট দেখা দিতে পারে
- সারা গায়ে হাত পায়ে চুলকানির জন্য
- অতিরিক্ত জোরে নাক ডাকার কারণে
- হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখলে ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় সঠিকভাবে ঘুম হওয়ার জন্য কিছু টিপস
- ডিনারের পরে অনেকটা সময় অপেক্ষা করে ঘুমোতে যান। কমপক্ষে ২ ঘন্টা আগে খাবার খেয়ে নিন।
- প্রত্যেকদিন একই সময়ে ঘুমোতে যাওয়ার অভ্যেস করুন।
- এনার্জি ড্রিংকস, কফি এবং মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন।
- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনি এক গ্লাস গরম দুধ পান করুন।
- চিনি কম পরিমানে খাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে গুড় খেতে পারেন।
- ঘুমোতে যাওয়ার আগে আপনি আপনার ফোন, ল্যাপটপ এবং টিভি থেকে দূরে থাকুন।
- ঈষৎ উষ্ণ জলে স্নানের চেষ্টা করুন, দিনের শেষে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে দেয়।
- ঘুমোনোর সময় যাতে সঠিক ভাবে বায়ু চলাচল করতে পারে, তার দিকে নজর দিন।
- আপনার সঙ্গীর সাথে কথা বলে ঘুমোতে যান।
গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার জন্য আপনার স্বাস্থ্য বা আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। তাই না ঘুম হওয়া অভ্যাস গড়ে ওঠার আগেই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন।
গর্ভাবস্থায় ঘুমের অভাবের জন্য কি সমস্যা হতে পারে ?
- সময়ের আগে প্রসব হতে পারে, তাই বাচ্চা প্রিম্যাচিউর হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- বাচ্চার ওজন সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্মানোর সময় বাচ্চার ওজন কম হতে পারে।
- এছাড়া গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে ঘুমের অভাবে প্রসব যন্ত্রনা বৃদ্ধি পেতে পারে, অস্বস্তি বোধ বেড়ে যায় শরীরে ও সি-সেকশন দ্বারা বাচ্চা প্রসবের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় সেরা ঘুমের অবস্থান
প্রথম ট্রাইমেস্টার
- যেকোনো এক পাশে ভর দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। এতে গর্ভবতী মহিলার রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে (4) । চিৎ হয়ে শোবেন না।
- গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে পিঠে ভর দিয়ে হালকা উঠে বসেও ঘুমোতে পারেন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার
- যদি আপনার পিঠে ব্যথা হয়ে থাকে তাহলে বা দিকে কাত হয়ে শোওয়ার চেষ্টা করুন। তলপেটের নিচে একটি বালিশ নিতে ভুলবেন না।
- অনেক সময় ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়, তখন পিঠের পিছনে বালিশ দিয়ে উঠে বসুন হালকা।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার
- এই সময় বাঁ দিকে কাত করে ঘুমোনোই শ্রেয়। তবে এই সময় পেট যেহেতু অনেকটাই বেড়ে যায় , তাই নিজের সুবিধে মতো শোওয়া প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় ঘুমোনোর সময় কি কি অবস্থান এড়িয়ে চলা উচিত ?
- চিৎ হয়ে শোবেন না। যেহেতু পেটের ওজন বৃদ্ধি পায়, তাই এই ভাবে শুলে পিঠে তীব্র পিঠে ব্যথা হতে পারে।
- পেট চেপে কখনোই শোবেন না।
গর্ভাবস্থায় ঘুমোনোর সমস্যা প্রায় প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার হয়ে থাকে, তবে এটি বেশ অনেকদিন ধরে স্থায়ী হলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নিজের যত্ন করুন, নিজের মন ভালো রাখুন ও সুস্থ থাকুন।
References
2. Sleep Deprivation during Pregnancy and Maternal and Fetal Outcomes: Is There a Relationship? by NCBI
3. Physiologic and pharmacokinetic changes in pregnancy by NCBI
4. RISK and the Pregnant Body by NCBI
Community Experiences
Join the conversation and become a part of our vibrant community! Share your stories, experiences, and insights to connect with like-minded individuals.