শিশুর ম্যাসাজ বা মালিশের পদ্ধতি ও উপকারিতা | How To Massage Babies In Bengali

Written by MomJunction
Last Updated on

একটি শিশুর জন্মের পর তার কাছে মাতৃদুগ্ধ যেমন জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি তার নিয়মিত মালিশ বা ম্যাসাজ। যুগ যুগ ধরে ভারতে এই শিশু মালিশের প্রথাটি চলে আসছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার বহু উন্নতি ঘটলেও, আজও চিকিৎসকরা সদ্যোজাতের পরিবারকে শিশুর মালিশের জন্য পরামর্শ দেন। তবে এই মালিশ প্রথা যে কেবলমাত্র শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্যই উপকারী, তা নয়। বরং এই মালিশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট থেকেই ওই শিশু ও তার মায়ের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এই প্রতিবেদনে আমরা শিশু মালিশের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরব। আমরা আলোচনা করব কীভাবে শিশুদের মালিশ বা ম্যাসাজ করা উচিত , তার প্রক্রিয়া এবং তাতে কী লাভ হয় সে সমস্ত বিষয় নিয়ে।

শিশুর ম্যাসাজ কী?

সাধারণত শিশুর মালিশ বা ম্যাসাজ তার মা কিংবা পরিবারেরই কোনও সদস্য করে থাকেন। তবে বর্তমানে অনেকেই শিশুর মালিশের জন্য পারদর্শী কাউকে সেই কাজে নিযুক্ত করা হয়। এই মালিশের সময় অনেকেই তেল কিংবা বিশেষত মালিশের জন্যই তৈরী কোনও লোশন ব্যবহার করে থাকেন। চলতি ভাষায় শিশুর এই মালিশ পদ্ধতিকে অনেকে “দলাই-মলাই”ও বলে থাকেন। হালকা হাতে করা এই দলাই-মলাই বা মালিশের মাধ্যমে শিশুর শারীরিক বিকাশ ঘটে। এছাড়া এর ফলে পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও শিশুর সম্পর্ক নিবিড় হয়।

মূলত একটি নির্দিষ্ট ছন্দে হাত দিয়েই শিশুর শরীরে এই ম্যাসাজ বা মালিশ করা হয়ে থাকে। এর ফলে শিশুর পেশি যেমন শক্ত হয়, তেমনই শিশুটি আরামবোধও করে। বিশেষ করে শিশুদের আঙুল, কব্জি, গোড়ালির গিঁটে মালিশ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

শিশুদের মালিশ করলে কী কী উপকারিতা পাওয়া যায়?

আমরা শুরুতেই সামান্য উল্লেখ করেছি যে শিশুদের শরীরে মালিশ করলে কী উপকার পাওয়া যায়। এবার আমরা এখানে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব যে, এই মালিশের ফলে কী কী লাভ হয়ে থাকে। নীচে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া রইল (1)

১. শিশুদের ঘুম ভালো হয়

শিশুদের ভালো ঘুম আসার জন্য মালিশ একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। ঠিক ঘুমের আগে শিশুর শরীরে ম্যাসাজ করা হলে তাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে মালাটোনিন উৎপন্ন হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই হরমোন ভালো ঘুমের জন্য ভীষণভাবে সহায়ক।

২. শিশুদের মাংসপেশীতে আরাম ও ক্লান্তি দূর হয়

সঠিক পদ্ধতিতে ম্যাসাজ করলে সহজেই শিশুদের সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ম্যাসাজের ফলে শিশুদের শরীরে অক্সিটক্সিন হরমোন উৎপন্ন হয়। এই হরমোন উৎপন্ন হলে শিশুরা খুব সহজেই খুশি হয়। পাশাপাশি মালিশের ফলে তাদের শরীরে ক্লান্তি উদ্রেককারী হরমোন দূর হয়ে যায়। এছাড়া, সঠিক ম্যাসাজ শিশুদের মাংসপেশীকে আরাম দিতেও ভীষণ সাহায্য করে।

৩. শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বৃদ্ধি পায়

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, শিশুদের যেভাবে স্পর্শ করা হয়, তা তাদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে প্রভাব ফেলে।

৪. শিশুর স্নায়ুতন্ত্র উত্তেজিত হয়

শিশুদের শরীরে তেল মালিশ করলে সহজেই তাদের স্নায়ুতন্ত্র উত্তেজিত হয়। এর ফলে তাদের মাংসপেশী মজবুত হয় ও তাতে সমন্বয় বজায় থাকে।

৫. পাচন, রক্ত সসঞ্চালন ও শ্বাস প্রশ্বাসে সুবিধে

শিশুকে সঠিকভাবে মালিশ করলে তাদের কান্নাকাটির বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই কম হয়ে যায়। ফলে তাদের পাচন, হজম ক্ষমতা বাড়ে এবং রক্ত সঞ্চালন খুব ভালো ভাবে হয়। এছাড়া শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও তাদের কোনও সমস্যা হয় না। পাশাপাশি শিশুদের ম্যাসাজ করলে তাদের শরীরে গ্যাস কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যের কোনও অসুবিধেও হয় না।

২০০৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে (2) , ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) থাকা যেসব শিশুদের নিয়মিত ম্যাসাজ করা হয়, তারা অনেক দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। ফলে মালিশ না পাওয়া শিশুদের তুলনায় তাদের অনেক কম সময় হাসপাতালে থাকতে হয়। এছাড়াও মালিশ পাওয়া শিশুরা বিভিন্ন শারীরিক কিংবা মানসিক উন্নয়নমূলক পরীক্ষায় তুলনামূলক ভালো ফল করে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে প্রসব পরবর্তী যে কোনও জটিলতাই কম দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বরং যেসব শিশুদের যথাযথ মালিশ মেলে তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা ঠাণ্ডা লাগার মতো সমস্যাগুলি থেকেও দূরে থাকে।

কখন থেকে শিশুকে মালিশ বা ম্যাসাজ করা শুরু করবেন?

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুর জন্মের চার সপ্তাহ পর থেকে তার শরীরে মালিশ বা ম্যাসাজ শুরু করা উচিৎ (3)। অনেক চিকিৎসকেরা আবার জানান, শিশুর বয়স ছয় সপ্তাহ না হওয়া অবধি তেল মালিশ করা উচিৎ না। তবে প্রত্যেক শিশুর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আলাদা। তাই শিশুর ম্যাসাজ শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নাওয়া উচিত । তবে শিশুর জন্মের চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সঠিকভাবে শিশুদের ত্বকের বিকাশ ঘটে এবং নাভিমূলও আলাদা হয়ে যথাযথ গড়ন পেয়ে যায়। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যেন শিশুদের নাভিমূল ভেঙে আলাদা হয়ে যাওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার পরই তাদের পেটে মালিশ করা হয়।

শিশুর ম্যাসাজের জন্য সেরা সময়

শিশু যদি অনেকক্ষণ কিছু না খেয়ে থাকে অর্থাৎ খালি পেটে থাকলে কিংবা শিশু ক্লান্ত থাকলে শিশুর শরীরে ম্যাসাজ বা মালিশ করা একেবারেই উচিত নয়। কারণ, এইরকম অবস্থায় মালিশ করলে শিশু সেই মালিশের ফল পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবে না। তবে দিনের যেকোনও সময়ই আপনি শিশুর শরীরে মালিশ বা ম্যাসাজ করতে পারেন। এছাড়াও শিশুর স্নানের সময়, স্তনপানের সময় কিংবা তার ঘুমোতে যাওয়া এবং ওঠার সময় অনুসারে বাড়ির সদস্যরা মালিশের সময় ঠিক করতে পারেন। তবে মা কিংবা বাড়ির সদস্যদের শিশুর দৈনিক কাজকর্ম অর্থাৎ তার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, স্নানের একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করে নেওয়া উচিৎ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যেমন- প্রথমে শিশুর মালিশ করুন, তারপর শিশুকে স্নান করান এবং এরপর শিশুকে ঘুম পাড়ান। এভাবে রুটিন মেনে নির্দিষ্ট সময়ে রোজ শিশুর কাজগুলি পরপর করলে সেও দ্রুত তা বুঝতে পারবে। তবে এই প্রক্রিয়াটি অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। ফলে প্রথম প্রথম এই রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শিশুটির পক্ষে একটু সমস্যাদায়ক হতে পারে। কারণ, এই লম্বা সময়ের মধ্যে শিশুর আবার খিদে পাওয়া খুব স্বাভাবিক। তাই শুরুতেই শিশুর মালিশ করা এবং তাকে স্নান করানোর মধ্যে সময়ের অন্তর কম করা ভীষণ জরুরি। এছাড়াও রাতে ঘুমোনোর আগে আপনি শিশুর ম্যাসাজ করতে পারেন। সঠিক ম্যাসাজের ফলে তার শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায় এবং আপনার শিশু তাতে রাতে আরামে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে শিশুরা খুব কান্নাকাটি করছে, সেই ক্ষেত্রে সন্ধের দিকে শিশুদের শরীরে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়। তবে প্রথম কয়েকদিন ম্যাসাজ করার সময় একটু খেয়াল করুন কোন সময়ে ম্যাসাজ করলে আপনার শিশু সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছে। সেই সময়েই বিশেষ করে তার ম্যাসাজ করার চেষ্টা করুন।

কীভাবে ধাপে ধাপে শিশুর ম্যাসাজ বা মালিশ করবেন?

সাধারণভাবে দেখে মনে হয় শিশু মালিশ করা সহজ একটি কাজ, কিন্তু ভীষণ যত্নশীল হয়ে তবেই শিশুর শরীরে মালিশ করা উচিত। এমনিতেই সদ্যোজাত শিশুদের শরীর এবং ত্বক ভীষণ নরম হয়। তাই তাদের মালিশ করার জন্য সঠিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি জানা অত্যন্ত জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে যাতে শিশুর জন্মের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে খুব জোরে জোরে তার শরীরে মালিশ না করা হয়। তাই ঠিক কোন পদ্ধতিতে শিশু ম্যাসাজ বা মালিশ করা উচিৎ, তা আমরা নীচে আলোচনা করলাম।

প্রথম ধাপ

শিশুকে মালিশ করার আগে প্রস্তুত করুন

শিশুর শরীরে তেল মালিশ করার আগে তাকে এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আচমকা এই প্রক্রিয়া শুরু করে দিলে অনেক সময় শিশু ভয় পেয়ে কান্নাকাটি পর্যন্ত শুরু করে দেয়। তাই শুরুতেই দেখে নিতে হবে শিশু শান্ত এবং ভালো মুডে রয়েছে কিনা। এর জন্য শুরুতেই আপনাকে শিশুর হাতের তালুতে একটু একটু করে তেল লাগাতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে শিশুর পেট কিংবা কানের পেছনে তেল লাগান। এর ফলে ধীরে ধীরে শিশু এই প্রক্রিয়াটির সঙ্গে পরিচিত হবে। তবে এই প্রক্রিয়া চলাকালীন যদি শিশু কান্নাকাটি কিংবা হাত-পা ছোড়া শুরু করে, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার শিশু এখনও মালিশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। আর যদি তেল লাগানো শুরু করার পরও সে শান্ত থাকে, তাহলে শিশুকে সম্পূর্ণভাবে মালিশ করা শুরু করতে পারেন।

দ্বিতীয় ধাপ

শিশুর পায়ে মালিশ

  • যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার শিশু তেল মালিশের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তখন সবার প্রথমে আপনি শিশুর পায়ে তেল মালিশ করুন। আপনি নিজের হাতের তালুতে সামান্য তেল নিন এবং শিশুর পায়ের তলায় হালকা হাতে ম্যাসাজ শুরু করুন। এরপর শিশুর পায়ের আঙুল এবং গোড়ালিতে মালিশ করুন। এরপর আপনার হাতের তালু দিয়ে শিশুর পায়ের নীচে ও ওপরে আলতোভাবে হাত বোলান। এরপর আপনি হাতের আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে পায়ের পাতা ও পায়ের তলায় গোল গোল করে ঘুরিয়ে মালিশ করতে থাকুন।
  • এরপর শিশুর একটি পা ওপরে তুলে ধরুন এবং গোড়ালির কাছে গিয়ে হালকা হাতে মালিশ করুন। এভাবে মালিশ করতে করতে ধীরে ধীরে শিশুর উরুর কাছ অবধি যান। একইভাবে শিশুর অপর পায়েও মালিশ করুন।
  • এরপর আপনি নিজের হাত দিয়ে শিশুর উরুর কাছে ধীরে ধরে টিপুন।
  • এরপর শিশুর পা হাঁটুর কাছে গিয়ে ভাঁজ করুন এবং ওই হাঁটু দিয়েই আলতো করে শিশুর পেটে চাপ দিন। এতে করে শিশুর পেটে জমে থাকা গ্যাস সহজেই বাইরে বেরিয়ে আসে।

তৃতীয় ধাপ

শিশুর হাতে মালিশ

  • পায়ে মালিশ হয়ে যাওয়ার পর এবার শিশুর হাতে মালিশ করুন। এর জন্য প্রথমে শিশুর হাতটি ধরুন এবং তার হাতের তালুতে আপনার হাত বোলান।
  • এরপর তেল দিয়ে শিশুর হাতের তালু থেকে শুরু করে আঙুলের গিঁট পর্যন্ত হালকা করে মালিশ করুন।
  • এরপর ধীরে ধীরে বাচ্চার হাতটি ভাঁজ করুন। এবার হাতের পেছন থেকে শিশুর হাতের কবজি পর্যন্ত ধীরে ধীরে মালিশ করুন।
  • এরপর শিশুর কবজি ধরে গোল গোল করে ঘুরিয়ে (যেভাবে চুড়ি পরানো হয়) মালিশ করুন।

চতুর্থ ধাপ

শিশুর বুকে এবং কাঁধে মালিশ

  • হাত ও পায়ের পর আসে শিশুর বুক ও কাঁধ মালিশ করার পালা। এর জন্য আপনাকে শিশুর কাঁধ থেকে শুরু করে বুক পর্যন্ত ধীরে ধীরে মালিশ করতে হবে।
  • এইভাবে ২ থেকে ৩ বার শিশুর বুকে ও কাঁধে মালিশ করুন।
  • এরপর হাল্কা করে শিশুর বুকে হাত রেখে বাইরের দিক পর্যন্ত মালিশ করুন।

পঞ্চম ধাপ

শিশুর পেটে মালিশ

  • শিশুদের পেট ভীষণ নরম এবং স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। তাই খুব জোরে সেখানে চাপ দেওয়া উচিত নয়। পেটে মালিশ করার ক্ষেত্রে শিশুর বুকের নীচের অংশ থেকে ম্য্যাসাজ করা শুরু করুন।
  • এরপর আপনার দুই হাত শিশুর পেট ও নাভির আশেপাশে গোল গোল করে ঘুরিয়ে মালিশ করুন।

ষষ্ঠ ধাপ

শিশুর মাথা ও মুখে মালিশ

  • এর জন্য প্রথমেই আপনাকে তর্জনী আঙুলটি শিশুর মাথায় রাখতে হবে। এরপর আলতো করে চাপ দিয়ে শিশুর মুখের বিভিন্ন অংশে মালিশ করা শুরু করতে হবে।
  • এরপর শিশুর চিবুক থেকে তার গাল পর্যন্ত গোল গোল করে আপনার আঙুলগুলি নিয়ে যান ও মালিশ করুন। ২-৩ বার এভাবেই শিশুর মুখে ম্যাসাজ করুন।
  • ঠিক যেভাবে আমরা চুলে শ্যাম্পু করি, সেভাবে শিশুর চুলের গোড়ায় তেল লাগিয়ে মালিশ করুন। বাচ্চাদের মাথা কিন্তু ভীষণ নরম হয়। তাই ভীষণ যত্ন করে আলতো হাতে তাদের মাথায় মালিশ করবেন।

সপ্তম ধাপ

শিশুর পিঠে মালিশ

  • এই মালিশের জন্য শুরুতেই শিশুকে উপুড় করে অর্থাৎ পেটের ওপর ভর দিয়ে শোয়াতে হবে। এবং এই অবস্থায় শিশুর হাতদুটি সামনের দিকে রাখতে হবে।
  • এবার আপনার হাতের গিঁটের অংশগুলি শিশুর পিঠের উপর দিকে রাখুন। এরপর গিঁটের ভরেই দু’হাত গোল গোল করে ঘোরাতে ঘোরাতে শিশুর পিঠের নীচের দিকে নামুন। এই একই পদ্ধতিতে দু’তিন বার অবধি শিশুর পিঠ মালিশ করুন। তবে শিশুর মেরুদণ্ডের হাড়ের ওপর একেবারেই নিজের আঙুল যাতে না রাখেন, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

কতবার বা কত ঘন ঘন শিশুর মালিশ করা উচিত ?

কিছু কিছু পরিবারে শিশু জন্মানোর পর তিন মাস অবধি দিনে দু’বার করে শিশুর মালিশ করা হয়। আবার কেউ কেউ শিশুকে স্নানের আগে কিংবা স্নান করানোর পরও মালিশ করে থাকেন। তবে ঠিক কতবার শিশুর মালিশ করা উচিত , এর কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। বরং শিশু মালিশ কতবার করা হবে এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে শিশু ও তার পরিবারের ওপর। যেমন মালিশ পেয়ে শিশু তা কতটা উপভোগ করছে কিংবা পরিবারের যিনি শিশুর মালিশ করেন, তাঁর কাছে কতটা সময় আছে, এসব কিছুর ওপরই শিশুর মালিশের সময় নির্ভর করে।

শিশু মালিশ নিয়ে কিছু জরুরি টিপস

শিশুর শরীরে মালিশ বা ম্যাসাজ করলে তার শরীরের বিকাশ সঠিক ভাবে হয়ে থাকে। আপনারাও যাতে সেই বিষয়ে সমস্ত কিছু জানতে পারেন, তাই সেই বিষয়ক কিছু টিপস আমরা নীচে উল্লেখ করলাম (2)। এছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে আমরা আলোচনা করব যা আপনাদের জানা বিশেষভাবে জরুরি। সেগুলিও নীচে দেওয়া রইল।

  • শিশুর শরীরে ম্যাসাজ বা মালিশের জন্য কখনোই খুব ঠাণ্ডা তেল ব্যবহার করবেন না। আর যদি শীতকাল হয় কিংবা আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকে, তাহলে আপনি মালিশের তেল হালকা করে গরম করে নিতে পারেন।
  • তেল মালিশ করার সময় আপনার শিশুর চোখের দিকে তাকান। এর ফলে আপনার ও শিশুর মধ্যে “আই কন্ট্যাক্ট” তৈরি হবে। এর ফলে বাচ্চাও আপনার দিকে দেখবে এবং আপনাদের দুজনের সম্পর্ক দৃঢ় হবে।
  • তেল মালিশ হয়ে যাওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই শিশুকে স্নান করিয়ে দিন। এর থেকে বেশীক্ষণ শিশুকে গায়ে তেল লাগানো অবস্থায় ফেলে রাখবেন না।
  • তেল মালিশ করার সময় খুব সতর্ক থাকবেন, যাতে তেল শিশুর চোখে না ঢুকে যায়। এর ফলে শিশুর চোখে তীব্র জ্বালার সৃষ্টি হতে পারে।
  • মালিশ করার পর শিশুকে উষ্ণ গরম জলে স্নান করান। এর ফলে শিশুর শরীর থেকে তেলতেলে ভাব দ্রুত মুছে যাবে।
  • শিশুকে খাওয়ানো এবং তেল মালিশ করার মধ্যে অন্তত ৩০-৪৫ মিনিটের অন্তর রাখবেন। খাবার কিংবা দুধ খাওয়ানোর পরপরই মালিশ করা শুরু করলে শিশুর বমি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • নরম চট কিংবা তোয়ালে পেতে তারওপর শিশুকে শুইয়ে মালিশ করুন।
  • শিশুকে মালিশ করার আগে একবার ভালো করে দেখে নিন শিশুর মুড কেমন রয়েছে? দেখবেন, মালিশ করার সময় যেন শিশু শান্ত থাকে কিংবা তার মুড যেন ভালো থাকে। তবেই শিশুর শরীরে মালিশ করা শুরু করুন। শিশুকে মালিশ শুরু করার পর যদি সে অস্বস্তি বোধ করে, তাহলে আর শিশুকে সেই মুহূর্তে মালিশ করবেন না।

শিশুর জন্য সেরা ম্যাসাজ তেল

শিশুকে ম্যাসাজ বা মালিশ করার জন্য সঠিক তেল নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। আপনি আপনার শিশুর শরীরে মালিশ করার জন্য কী কী তেল ব্যবহার করতে পারেন, সেই বিষয়ে নীচে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করলাম।

১. নারকেল তেল

শিশুদের শরীরে ম্যাসাজের জন্য নারকেল তেল একটি অন্যতম উপাদান। নারকেল তেলে প্রচুর পরিমাণে ছত্রাকবিরোধী (অ্যান্টি ফাংগাল) এবং বিভিন্ন জীবাণুবিরোধী (অ্যান্টি ব্যাক্টিরিয়াল) গুণ থাকে। শিশুর ত্বকের জন্য তাই এই তেল ভীষণ উপকারী।

২. জলপাইয়ের তেল

জলপাইয়ের তেল সাধারণ অলিভ অয়েল নামেই বেশি পরিচিত। এই তেল শিশুদের ত্বকের জন্য ভীষণ উপকারী। তবে শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিদেশেও শিশুদের মালিশের জন্য এই তেল বহুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

৩. কাঠবাদামের তেল

শিশুর শরীরে মালিশ করার জন্য আপনি কাঠবাদামের তেল বা আমন্ড অয়েলও ব্যবহার করতে পারেন। কাঠ বাদামের তেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই থাকে। ভিটামিন-ই শিশুদের যথাযথ পরিমাণে পুষ্টি দেয় ও শিশুদের ত্বক নরম করতে সাহায্য করে (4)

৪. সরষের তেল

শিশুদের ম্যাসাজের জন্য সরষের তেলও ভীষণ উপকারী। সর্ষের তেল শিশুদের শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু সর্ষের তেল শিশুর ত্বককে ভীষণ মসৃণ করে দেয়। তাই এই তেল যদি অন্য কোনও তেলের মধ্যে মিশিয়ে তারপর মালিশের জন্য ব্যবহার করা যায়, তাতে বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়।

৫. ক্যাস্টর অয়েল

শিশুকে স্নান করানোর আগে যদি ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে তাকে মালিশ করা যায়, তবে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। এই তেল শিশুদের ত্বক থেকে রুক্ষতা দূর করে ও পুষ্টি জোগায়।

৬. তিলের তেল

শিশুর শরীরে মালিশের জন্য আপনি তিলের তেলও ব্যবহার করতে পারেন। আপনার এলাকার আশেপাশের বাজারে এই তেল আপনি সহজেই পেয়ে যাবেন।

৭. সূর্যমুখী ফুলের তেল

যদি আপনার শিশুর ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল বা সেন্সেটিভ হয়, তাহলে আপনি এই সূর্যমুখী ফুলের তেল ব্যবহার করতে পারেন। এই তেল মূলত সানফ্লাওয়ার অয়েল নামেই বেশি পরিচিত। এই তেলে ভিটামিন-ই এবং ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা শিশুর ত্বকে পুষ্টি জোগায়।

৮. টি-ট্রি অয়েল

যেসব শিশুদের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল বা সেন্সেটিভ, সেই শিশুদের শরীরে তেল মালিশের জন্য এই টি-ট্রি অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। এই তেল শিশুদের ত্বকের জন্য ভীষণ পুষ্টিকর এবং এতে জীবাণুমুক্ত (অ্যান্টিসেপ্টিক) করারও বহু গুণ রয়েছে।

৯. বেবি অয়েল

আজকাল বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির বেবি অয়েল বিক্রি হয়ে থাকে। তার মধ্যে থেকে সব রকম গুণাবলী থাকা একটি বেবি অয়েল বেছে নিয়ে তাও আপনি আপনার শিশুর শরীরে ম্যাসাজ করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।

কখন শিশুর শরীরে মালিশ করা উচিত নয়?

যদি আপনি দেখেন আপনার শিশুর শরীরে কোনও রকম ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ বেরোচ্ছে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া তার ত্বকে কোনও রকম ক্রিম বা তেল লাগাবেন না। এছাড়া যদি আপনি দেখেন যে কোনও তেল বা ক্রিম ব্যবহারের ফলে শিশুর শরীরে কোনও রকম দাগ তৈরি হচ্ছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্রিম বা তেল ব্যবহার করা আপনি বন্ধ করে দেবেন। এইরকম অবস্থায় আগে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে তবেই আপনি শিশুর শরীরে মালিশ করার সিদ্ধান্ত নিন (5)

আবার কিছু চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞরা বলেন, জ্বর হলে কিংবা কিংবা কোনও কারণে শিশুর শরীর ভালো না থাকলে মালিশ করা উচিত নয়। আবার কিছু কিছু ডাক্তার বলেন, জ্বর হলে হাল্কা হাতে তার শরীর মালিশ করলে শিশু ব্যথার হাত থেকে কিছুটা আরাম পায়। তাই শিশুর জ্বর হলে কিংবা শরীর ভালো না থাকলে তার শরীরে মালিশ করার আগে একবার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়াই ভালো। অনেক সময় হতেই পারে আপনার শিশুর শরীর বেশি খারাপ, তাই চিকিৎসক আপনাকে মালিশ না করার পরামর্শও দিলেন।

কখন শিশুর শরীরে মালিশ করা বন্ধ করা উচিত?

ঠিক কতদিন অবধি শিশুকে মালিশ করা উচিত, এর কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম বা সময়সীমা নেই। আপনার যতদিন ইচ্ছে, ততদিন পর্যন্তই আপনি আপনার শিশুর শরীরে ম্যাসাজ করতে পারেন। তবে ভালো হয়, যদি আপনি লক্ষ্য রাখেন আপনার শিশু এই মালিশ করার প্রক্রিয়া ঠিক কতটা উপভোগ করছে। অনেক সময় এই গোটা বিষয়টি পরিবারের ওপরও নির্ভর করে যে তারা কতদিন অবধি এই মালিশের ব্যাপারটি বজায় রাখতে চান। কিছু কিছু পরিবারে শিশুর পাঁচ-ছয় বছর বয়স অবধিও তার শরীরে মালিশ করা হয়। এই বয়সের বাচ্চাদের শরীরে সপ্তাহে তিন থেকে চার বার করা হয়ে থাকে। মোট কথা, আপনি আপনার শিশুর শরীরে কতদিন অবধি মালিশ করতে চান, তা সম্পূর্ণ আপনার ওপরই নির্ভরশীল।

ঘুমন্ত অবস্থায় কি শিশুর শরীরে মালিশ করা উচিত?

ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুর শরীরে মালিশ করা উচিত নয়। ঘুমের সময় শিশুদের ম্যাসাজ করলে তাদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার ফলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং কান্নাকাটি শুরু করে। তাই যখন শিশুর ঘুম সম্পূর্ণ হলে এবং সে ভালো মুডে থাকলে তবেই তার শরীরে ম্যাসাজ করা উচিত।

শিশুর শরীরে মালিশ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করলাম যা আপনার ও আপনার শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর ফলে আপনি সঠিক পদ্ধতি ও সময়ে আপনার সন্তানের মালিশ করতে পারবেন। আমরা আশা করি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনি এই বিষয়ে যথযথ জানতে পারলেন এবং এই লেখনী আপনার ও আপনার সন্তানের জন্য যথেষ্ট কার্যকরী হবে।

নিজে সুস্থ থাকুন ও বাচ্চার যত্ন নিন।

References

Was this article helpful?
thumbsupthumbsdown
Latest Articles